- বাংলাদেশ
- হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত শেষ
হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত শেষ

ছবি: সংগৃহীত
গত মার্চে মুজিব জন্মশতবর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলাম। এসব ঘটনায় সারাদেশে ১৫৪টি মামলা দায়ের করা হয়। সহিংসতার প্রায় পাঁচ মাস পার হলেও মামলাগুলোর তদন্ত কতদূর এগোলো, কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অভিযোগপত্রে কারা আসামি হচ্ছেন- সমকালের পক্ষ থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, হেফাজতের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত প্রায় শেষ করে এনেছে পুলিশ। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের বিরুদ্ধে দায়ের নতুন-পুরোনোসহ ১৩টি মামলার চার্জশিট দু-এক মাসের মধ্যে জমা দেওয়া সম্ভব হবে। নীতিনির্ধারকদের সবুজ সংকেত পেলে চার্জশিট দিতে প্রস্তুতও মামলার তদন্ত সংস্থা। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন-পুরোনো মিলিয়ে হেফাজতের বিরুদ্ধে ২১৪টি মামলা তদন্তাধীন। হেফাজত তাণ্ডবের ঘটনায় এ পর্যন্ত এক হাজার ৫০৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হেফাজতের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় মোট এজাহারভুক্ত আসামি তিন হাজার ২৭০ জন। এর বাইরে অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে ৮৩ হাজার ৯১৫ জন। বেশ কিছু মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তাণ্ডবের ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল তা উঠে আসে।
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে নজিরবিহীন নাশকতা চালায় হেফাজত। ওই ঘটনায় দায়ের করা ৬০টি মামলার তদন্ত দীর্ঘদিন থমকে ছিল। হেফাজতের গতিবিধির ওপর নজর রেখে এক ধরনের চাপে রাখার কৌশল হিসেবে মামলাগুলো কার্যত 'ফ্রিজবন্দি' ছিল বলে মনে করেন অনেকে। তবে এবার মোদির সফর ঘিরে ফের হেফাজত সহিংস রূপে আত্মপ্রকাশ করায় সংগঠনটির নতুন-পুরোনো সব মামলার তদন্তে গতি পায়। একের পর এক গ্রেপ্তার হন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। এক পর্যায়ে হেফাজত তাদের পুরোনো কমিটিও ভেঙে দিতে বাধ্য হয়। এরপর ধর্মভিত্তিক সংগঠনটির পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করে মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেপ্তার অভিযান বন্ধের দাবি জানানো হয়। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে হেফাজতকে এই বার্তা দেওয়া হয়- সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ে আগুন দেওয়া, নৈরাজ্য ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের মতো ফৌজদারি অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো শৈথিল্য দেখানো হবে না।
সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, হেফাজতের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো ধরনের নাটকীয় পরিবর্তন না হলে বেশ কিছু মামলায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের আসামি করেই চার্জশিট দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কোনো তাড়াহুড়ো করছেন না তারা। তার ভাষ্য- হেফাজতের নেতাকর্মীরা আইন অমান্য করে শাস্তির মুখোমুখি না হলে তাদের মধ্যে আগামীতে আরও মারমুখী ও উদ্ধত মনোভাব দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত পুলিশি বিষয় হলেও সংগঠনটি ঘিরে নানামুখী সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আরও অনেক বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। এ ছাড়া হেফাজত নেতাদের অর্থ পাচারেরে তথ্য খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এরই মধ্যে মামুনুল হকসহ হেফাজতের একাধিক নেতার আয়বহির্ভূত অর্থ-সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, হেফাজতের বিরুদ্ধে দায়ের করা বেশ কিছু মামলার তদন্তে অনেক অগ্রগতি রয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কিছু মামলার চার্জশিটও দাখিল করব।
মামলার তদন্ত: পুলিশ সদর দপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, চলতি বছর হেফাজতের বিরুদ্ধে যে ১৫৪টি মামলা করা হয়, তার মধ্যে ১০৩টি মামলা পেনাল কোডে। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ২৩টি, বিস্ম্ফোরক আইনে ৯টি ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৮টি। একক জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে ৫৫টি মামলা করা হয়। ওই জেলায় দায়ের হেফাজতের পুরোনো মামলা রয়েছে ৮টি। জেলা পুলিশ তদন্ত করছে ৪৪টি মামলা। বাকি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের কাছে তদন্তাধীন মামলার আসামিদের মধ্যে ওই জেলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ৬৬২ জন। সেখানে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন ৬৪ জন। হেফাজতের পুরোনো আটটি মামলার তদন্ত জেলা পুলিশ শেষ করে এনেছে। আর নতুন পাঁচটি মামলার তদন্তেও বেশ অগ্রগতি রয়েছে। এই পাঁচ মামলা হলো- আশুগঞ্জে টোল প্লাজা ভাঙচুর, জেলা পুলিশ লাইন্স ও পুলিশের কার্যালয়ে হামলায় এবং আশুগঞ্জে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেছেন, হেফাজতের পুরোনো আটটি মামলার তদন্ত প্রায় শেষ। এক মাসের মধ্যে এসব মামলার চার্জশিট দেওয়া সম্ভব। আর নতুন মামলার মধ্যে পাঁচটি মামলার চার্জশিট দাখিল করতে আরও দুই মাস লাগতে পারে। সিসিটিভি ফুটেজসহ অন্যান্য অনেক আলামত বিশ্নেষণ করে জেলাজুড়ে নৈরাজ্যের ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল তা বের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মামুনুল হকের নাম এসেছে: হেফাজতের তাণ্ডবের ১৮টি মামলার তদন্ত করছে পিবিআই। সংস্থাটি যেসব মামলার তদন্ত করছে তার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে করা দুটি, নারায়ণগঞ্জের চারটি, মুন্সীগঞ্জের দুটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১০টি। এরই মধ্যে এসব মামলায় ১৩ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজির উত্তরপাড়া বায়তুল নাজাত জামে মসজিদের ইমাম ও হেফাজতের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সক্রিয় সদস্য আবু বকর সিদ্দিক আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, মামুনুল হক সিদ্ধিরগঞ্জ হেফাজতে ইসলাম সভাপতি মাহমুদুল হাসান পাটোয়ারীকে হরতালে কাজ করার নির্দেশ দেন। তিনি কাজ করেছেন মাহমুদুল হাসান পাটোয়ারীর নির্দেশনায়। এ ছাড়া পিবিআইর মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন ডেমরার আল মারকাজুল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও হেফাজত নেতা আজহারুল ইসলাম, মুফতি বশিরউল্লাহ এবং মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের মধুপুরের পীর মাওলানা আবদুল হামিদের দুই ছেলে আতাউল্লাহ ও মোহাম্মদ উল্লাহ। আদালতে দুই সহোদর মুন্সীগঞ্জে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় তাদের বাবাকে দায়ী করেছেন।
মামলার তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, পিবিআই তাদের তদন্তে হেফাজতের মামলার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বেশ কয়েকটি মামলার তদন্তে ভালো অগ্রগতি রয়েছে। তাণ্ডবের নেপথ্যে যাদের ভূমিকা ছিল তাও উঠে এসেছে। এ ছাড়া চলতি বছরের তাণ্ডবে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত যাদের নাম উঠে আসছে তারা হলেন- আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মুফতি ইলিয়াস হামিদী, মুফতি শরীফ উল্লাহ, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, মাওলানা জুবায়ের আহমেদ, সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, জুনায়েদ আল হাবিব, জালাল উদ্দিন, মুফতি শরাফত হোসাইন, খুরশিদ আলম কাসেমি, আবদুর রহিম কাসেমী, ওবায়দুল্লাহ, সোনারগাঁ উপজেলা হেফাজতে ইসলামের আমির মহিউদ্দিন খান, সেক্রেটারি শাহাজাহান ওরফে শিবলী, সহসভাপতি মোয়াজ্জেম প্রমুখ।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, সিআইডির কাছে তদন্তাধীন হেফাজতের ২৩ মামলার তথ্য সংগ্রহ, তথ্য সংযুক্তকরণ ও বিশ্নেষণের কাজ চলছে। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা হবে।
মন্তব্য করুন