- বাংলাদেশ
- প্রকৌশলীর পরিচয়ে সুকৌশলে প্রতারণা
প্রকৌশলীর পরিচয়ে সুকৌশলে প্রতারণা

সাইফুল ইসলাম সাগর
শ্রমিক ভিসায় কাতারে গিয়ে একটি সুপারশপে কাজ করতেন সাইফুল ইসলাম সাগর (২৮)। রাতে কিংবা অবসরে চষে বেড়াতেন ইন্টারনেট। ফেসবুকে তরুণীদের আইডিতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন তাদের বিষয়ে। নাম-ঠিকানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থলসহ যেসব ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুকে পাওয়া সম্ভব সংগ্রহে রাখতেন। তরুণীদের পোস্ট করা ছবি আর স্ট্যাটাস থেকে ধারণা নিতেন তাদের বর্তমান মানসিক অবস্থার।
সাগরের মূল টার্গেট বিষণ্ণতা বা হতাশায় ভুগছেন এমন তরুণীরা। প্রথমেই টার্গেট তরুণীকে 'ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট' পাঠাতেন না তিনি। যোগাযোগ করতেন ফেসবুক মেসেঞ্জারে। পরিচয় দিতেন কখনও সুইডেন, কখনও সুইজারল্যান্ড, কখনও-বা কাতার প্রবাসী প্রকৌশলী হিসেবে; কখনও জানাতেন, এমফিল করছেন।
কিছুদিন এভাবে চলার পর টার্গেট তরুণীকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া ছিল সাগরের প্রতারণার অন্যতম কৌশল। বিয়ের প্রলোভনে তরুণীর 'ব্যক্তিগত' ছবি এবং ভিডিও চাইতেন তিনি। কেউ কেউ এই ফাঁদে পা দিতেন। তারপর প্রতারণার শিকার হতে চলেছেন বুঝতে পেরে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন। তখন ভয়ংকর চেহারায় আবির্ভূত হতেন সাগর। ছবি পর্নোসাইটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে দিনের পর দিন আরও ছবি কিংবা ভিডিও পাঠাতে বাধ্য করা হতো তাকে।
দেশে থাকার সময়ও সাগরের 'ব্ল্যাকমেইলে'র শিকার হয়েছেন কয়েকজন তরুণী। ফাঁদে ফেলে তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও তৈরি করেছেন সাগর। তবে প্রতারণার শিকার হয়েও মানসম্মানের ভয়ে মুখ খুলতেন না কেউ। কিন্তু সম্প্রতি পেশায় চিকিৎসক এক তরুণীর অভিযোগে সাগরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। গত ২৮ জুন কাতার থেকে বিমানে এসে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সদস্যরা গ্রেপ্তার করেন তাকে।
কৌশলী সাগর কোনো তরুণীকেই আসল নাম-পরিচয় ও ঠিকানা দেননি। তার ফেসবুক আইডিও ছিল একাধিক। যে কারণে তাকে শনাক্ত করার মতো তেমন কোনো তথ্যই ছিল না। তবে এক তরুণী যে কোনোভাবে তার পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহে রেখেছিলেন। ওই পাসপোর্ট নম্বর ধরে সিআইডি তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে তার বিষয়ে তথ্য দিয়ে রাখে। ২৮ জুন বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার পরই ধরা পড়েন সাগর। সেখানে তাকে আটকে রেখে খবর দেওয়া হয় সিআইডিকে।
সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম সমকালকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও সঙ্গে পরিচয়ের ক্ষেত্রে তরুণীদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। অজ্ঞাত কারও পাঠানো বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করা উচিত নয়। যে মাধ্যমেই হোক না কেন, পরিচিত হওয়ার পর কেউ 'ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও' চাইলে বুঝতে হবে, তার অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।
তদন্ত সূত্র জানাচ্ছে, সাগরের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার জোতপাড়ায়। ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন তিনি। তবে পড়ালেখা শেষ না করেই ২০১৯ সালে শ্রমিক ভিসায় কাতার যান।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাগর তার অপকর্মের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। সিআইডি প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে, সাগর বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ২৫ জন তরুণীর 'ব্যক্তিগত' ছবি নিয়ে প্রতারণা করেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের 'ব্যক্তিগত' ছবি এবং ভিডিও পর্নোসাইটেও আপলোড করেছেন তিনি।
তদন্ত সূত্র জানতে পেরেছে, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন সাগর। একপর্যায়ে তারা প্রতারণা ধরতে পারলেও মানসম্মানের ভয়ে আইনের আশ্রয় নেননি। অবশ্য সাগরের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী সিআইডিতে যোগাযোগ করেছেন। তার বিরুদ্ধে কুমিল্লার একটি থানায় ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী পর্নোগ্রফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছেন।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মিরপুর থানায় এক চিকিৎসক সাগরের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের জুনে সাগর অজ্ঞাত ফেসবুক আইডি থেকে তার ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটি বার্তা পাঠান। মেসেজে সাগর জানান, তিনি ওই চিকিৎসক তরুণীকে চেনেন, জানেন এবং দেখেছেন। তার ছোট বোনও চিকিৎসক। তরুণীকে তিনি জানান, সুইডেনে 'ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজির' ছাত্র হিসেবে এমফিল করছেন। এভাবে তরুণীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তিনি।
কয়েকবার এভাবে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা বলার পর সাগর তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তরুণী তাকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সাগর জানান, এক মাস পর দেশে ফিরে তরুণীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। জুনের তৃতীয় সপ্তাহের পর তিনি ইমো অ্যাপস থেকে তরুণীর ইমোতে ফোন করে জানান, ১২ জুলাই দেশে ফিরবেন সুইডেন থেকে। ওই দিন দুপুরে বনানীতে সাগরদের বাসায় তরুণীর পরিবারকে বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য যেতে বলেন তিনি।
এজাহারে বলা হয়, ২০১৯ সালের ১১ জুলাই সকালে সাগর আবারও ইমোতে কল করে তরুণীর দুর্বলতার সুযোগে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু ব্যক্তিগত ছবি এবং ভিডিও পাঠাতে বলেন। পরদিনই বিয়ের কথাবার্তা হবে, এমন সরল বিশ্বাসে মেয়েটি ছবি এবং ভিডিও পাঠান। এরপর ১২ জুলাই সাগরের দেওয়া বনানীর ঠিকানায় গিয়ে তার বাসা পাননি তরুণীর স্বজনরা। এ সময় সাগরের যোগাযোগের সব মাধ্যমও বন্ধ পাওয়া যায়।
পরদিন ১৩ জুলাই সাগর নিজেই মেসেজ পাঠান। মেয়েটি জানিয়ে দেন, তিনি আর তার সঙ্গে যোগাযোগে আগ্রহী নন। এরপর সাগরের ভয়ংকর চেহারা বেরিয়ে আসে। তিনি হুমকি দেন, তার কথামতো না চললে তিনি তরুণীর 'ব্যক্তিগত' ছবি এবং ভিডিও পর্নোসাইটে ভাইরাল করে দেবেন। মানসম্মানের ক্ষতির চিন্তা করে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি যোগাযোগ বন্ধ না করলেও সাগরের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন।
একপর্যায়ে তরুণী জানতে পারেন, একাধিক মেয়ের সঙ্গে একইভাবে সাগর প্রতারণা করেছেন। তখন ২০১৯ সালের নভেম্বরে তিনি সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে একজন পরিচিত ব্যক্তি তাকে জানান, বিভিন্ন পর্নোসাইটে তার ছবি আর ভিডিও পাওয়া গেছে।
কুমিল্লা জেলার একটি থানায় করা মামলায় ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী বলেছেন, তাকেও বিয়ের প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন তুলে সাগর তার 'ব্যক্তিগত' ছবি এবং ভিডিও পাঠাতে বলেন। শিক্ষার্থীটি সাগরকে সেগুলো পাঠিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, তার প্রতি আস্থা রয়েছে। এভাবে সাগর একাধিকবার তাকে ছবি পাঠাতে বাধ্য করেন।
মন্তব্য করুন