- বাংলাদেশ
- মাল্টার কারাগারে দুর্বিষহ দিন কাটছে ওদের
সমুদ্রপথে ইউরোপ যাত্রা
মাল্টার কারাগারে দুর্বিষহ দিন কাটছে ওদের

প্রতীকী ছবি
যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়ার ইসমাইল হোসেন ও জাহিদা বেগমের সন্তান শেখ শাহাজান ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। এলাকার কয়েকজন তাকে ইউরোপে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ায় স্বপ্ন দেখায়। পরে তার অসচ্ছল বাবার যোগাযোগ হয় স্থানীয় একটি চক্রের সঙ্গে। তিনি জমি বন্ধক রেখে ও ধারদেনা করে ওই চক্রকে কয়েক দফায় মোট সাত লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য বদল তো দূরের কথা, শাহাজান এখন ইউরোপের দ্বীপ দেশ মাল্টার কারাগারে মানবেতর দিন যাপন করছেন।
তার মতোই দুরবস্থায় পড়েছেন কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার উত্তর জগন্নাথপুরের ঈমান হোসেন। তার বয়স ২০-২১। তার বাবা ধারদেনা ও কৃষিজমি বিক্রি করে দালালের হাতে ১০ লাখ টাকা দেন। এখন ছেলের বিদেশ বিভুঁইয়ে কারাজীবনের কথা শুনে পিতামাতার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন তারা।
একই অবস্থা হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও পশ্চিমপাড়া গ্রামের মিম্বর আলীর। স্নাতক পাস করা ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য বিভিন্ন মাধ্যম খুঁজছিলেন তার বাবা। একটা চক্র তাকে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। তিনিও এখন মাল্টায় কারাজীবন পার করছেন।
এসব তথ্য সরকারের দৃষ্টিতে এলে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল দ্বীপ দেশটি সফর করেছে। বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার প্রায় ১৭০ জন অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার সময় মাল্টা অবস্থানকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাজীবন পার করছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সেখান থেকে সুযোগ বুঝে ইউরোপের দেশ ইতালিতে প্রবেশ করা। এজন্য তাদের জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
এসব বাংলাদেশি রাজনৈতিক ও মানবিক আশ্রয় চেয়ে মাল্টা সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
এখন দেশটির সরকার এসব অবৈধ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠাতে চায়। দেশটিতে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস বা কনস্যুলেট অফিস নেই। গ্রিসের এথেন্সে অবস্থিত দূতাবাসের মাধ্যমে সবকিছু পরিচালিত হয়। এরই অংশ হিসেবে দূতাবাসের কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা দেশটিতে যান। সেখানে বন্দি বাংলাদেশিদের পাশাপাশি দেশটির সরকারের সঙ্গেও আলোচনা করেন তারা।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দালালের মাধ্যমে দ্বীপ দেশটিতে কীভাবে এসেছিলেন সেই সব লোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন বাংলাদেশিরা। তাদের ভাষ্যমতে, উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া হয়ে তারা সেখানে পৌঁছেছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে তাদের লিবিয়ায় নেওয়া হয়। এরপর তারা সাগরপথে মাল্টায় এসেছেন। অনেকেই নৌকাডুবে মারাও গেছেন। লিবিয়ায় থাকাকালে আরও টাকার দাবিতে তাদের ওপর দফায় দফায় শারীরিক নির্যাতন ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে দেশে তাদের লোকদের কাছে টাকা দেওয়ার জন্য বলা হয়। এরপর অভিভাবকরা পাচারকারীদের লোকের হাতে আরও টাকা তুলে দিয়েছেন। এভাবে অনেকের পরিবার এখন নিঃস্ব। এখন তাদের অনেকে দেশে ফিরতেও চান না। কারণ তারা ফেরত এলে তাদের পরিবারগুলো আর্থিক সংকটে পড়বে। আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছায় দেশে ফিরতে চাচ্ছেন। এজন্য তাদের ফিঙ্গার প্রিন্টসহ অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করেছে সরকারের প্রতিনিধি দল।
ভূমধ্যসাগরের বুকে ক্ষুদ্র একটি দেশ মাল্টা। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত। ভূমধ্যসাগরের আরামদায়ক আবহাওয়া, পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব গোছানো শহর, মানুষের পর্যটকবান্ধব মন, উন্নত অবকাঠামো এবং আকাশ ও সমুদ্রপথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশটিকে পর্যটকদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। প্রধানত তিনটি দ্বীপকে নিয়ে গঠিত দেশটির আয়তন মাত্র ৩২১ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা সাড়ে চার লাখের মতো। এত অল্প মানুষ নিয়েই মাল্টা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। অথচ এ দেশে পর্যটকের সংখ্যা শুনলে বিস্মিত হতে হয়। সাড়ে চার লাখ লোকের দেশে প্রতি বছর ভ্রমণ করে ২৬ লাখ মানুষ।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ ও মাল্টার সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। এর সূচনা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাল্টার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন। ১৯৭২ সালেই মাল্টা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই যেসব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের মধ্যে মাল্টা অন্যতম।
গত ১২ জানুয়ারি মাল্টা থেকে ৪৪ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। বিশেষ একটি ফ্লাইটে তাদের দেশে আনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আবারও অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে মাল্টা সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি চুক্তি হয়। 'স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) ফর রিটার্ন অব ইরেগুলার বাংলাদেশি ন্যাশনাল লিভিং ইন ইউরোপ' নামে এ চুক্তির আওতায় যেসব বাংলাদেশি অভিবাসী অনিয়মিতভাবে ইউরোপে বা মাল্টা প্রবেশ করে, তারা বৈধ হতে না পারলে সে দেশের সরকার বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করলে তাদের ফেরত আনা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্গমন শাখার তথ্যমতে, গত ১২ বছরে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে ৬২ হাজার ৫৮৩ জন বাংলাদেশি। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত তিন হাজার ৩৩২ বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। তাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।
জানা গেছে, মাল্টায় বন্দি বাংলাদেশি ফেরত আনার মূল দায়িত্ব পালন করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমকালকে বলেন, সরকারের কাছে তথ্য এসেছিল- বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার সময় মাল্টায় বেশকিছু বাংলাদেশি আটক আছে। বিষয়টি তাদের দৃষ্টিতে আসলে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করে। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যা করণীয় তাই করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে। এখন বিদেশিরা বাংলাদেশে এসে বরং চাকরি করছেন। টাকা রোজগারের জন্য অর্থ ব্যয় করে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার জন্য একাধিকবার আহ্বান জানানো হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। বৈধ পথে সন্তানদের বিদেশে পাঠানো যায় কিনা সেই চিন্তা করতে হবে অভিভাবকদের।
মন্তব্য করুন