ওকে প্রথম কবে দেখেছি, মনে করতে পারছি না। কিন্তু ওর প্রথম ছবিটি তুলেছিলাম ২০১৪ সালে; আবদ্ধাবস্থায়, অবশ্যই প্রকৃতি থেকে নয়। এদেশের প্রকৃতিতে ওকে দেখার ভাগ্য ক'জনেরই বা হয়েছে! গত শতাব্দীর আশির দশকে কক্সবাজার ও রাঙামাটির মিশ্র চিরসবুজ বনে একবার করে দেখার তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া আর কেউ কখনও প্রকৃতিতে ওকে দেখেছে বা ছবি তুলেছে- এমন তথ্য জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের অধীনে ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মতবিনিময়ের জন্য যাই। সে সময় মালয়েশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা পেরাক রাজ্যের তাইপেং জু অ্যান্ড নাইট সাফারি পরিদর্শন করার সুযোগ হয়। সেখানেই খাটো লেজের অতি বিরল এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটির সঙ্গে সপরিবারে দেখা হয়। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ওদের দু-চারটা ছবিও তুলে নিই। কারণ, এদেশে ওদের সঙ্গে আদৌ দেখা হবে কিনা, সন্দেহ!

দিন দশেক আগে শ্রীমঙ্গলে আমার এক বিশ্বস্ত লোকের কাছে খবর পেলাম, বাংলাদেশ বন বিভাগ শহরের একজনের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানায় (যা আইনে অবৈধ) অভিযান চালিয়ে একটি হিমালয়ান শকুন (Himalayan Vulture) ও এক জোড়া বাঁশভালুকের (Binturong) সঙ্গে অতি বিরল এই প্রাণীকেও জব্দ করে তাদের জানকিছড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে রেখেছে। আচমকা এদেশে প্রাণীটিকে দেখার একটি সুযোগ এলেও করোনা মহামারির কারণে ইচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে শ্রীমঙ্গল যাওয়া থেকে বিরত থাকলাম। কিন্তু উদ্ধার কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেঞ্জার শহীদুল ইসলাম ও আমার বিশ্বস্ত লোক মারফত ওদের প্রাত্যহিক খবরাখবর পেতে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত জানতে পারলাম, গত ১৭ আগস্ট বাঁশভালুক দুটিকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা হয়েছে। আর হিমালয়ান শকুনের সঙ্গে অতি বিরল স্তন্যপায়ী প্রাণীটির স্থান হয়েছে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের কোনো এক খাঁচায়। যতটুকু শুনেছি, ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার মালিক প্রাণীগুলোকে ১০-১৫ বছর আগে জোগাড় করেছিলেন এবং পোষ মানিয়ে ফেলেছিলেন। দীর্ঘদিন বন্দিদশায় থাকতে থাকতে ওরাও হয়তো বনের স্মৃতি ভুলে গেছে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, ওরা বুনো পরিবেশে টিকতে পারবে না। কাজেই সাফারি পার্কে বন্দিদশায় থাকাইওদের জন্য ভালো! এ দেশের চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্কের খাঁচা ওদের জন্য জেলহাজত বলে আমার কাছে মনে হয়।

যা হোক, যাদের থাকার কথা ছিল মুক্ত-স্বাধীন পরিবেশে, তারা কোন অপরাধে হাজতবাস করবে? আমাদের শখের খেসারত কেন এদের দিতে হবে? এত বছর পর এদের উদ্ধার করেই বা লাভ কী? আসলে 'বন্যেরা বনেই সুন্দর'; কোনো কৃত্রিম পারিবেশে নয়। আর এটা যতদিন এদেশের মানুষ বুঝতে না পারবে, ততদিন এদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ হবে না। এদেশের মানুষ কি আসলে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতির সংরক্ষণ চায়? মনে হয় না চায়। দুঃখের বিষয়, এভাবে চলতে থাকলে এক দিন এদেশে আর একটি বন্যপ্রাণীও অবশিষ্ট থাকবে না।

যাক এতক্ষণ খাটোলেজি অতি বিরল যে প্রাণীটির কথা বললাম, সে হলো এদেশের এক প্রজাতির বানর; খাটোলেজি বা ছোটোলেজি বানর। ইংরেজি নাম Stumped-tailed Macaque বা Bear Macaque| Cercopithecidae গোত্রের বানরটির বৈজ্ঞানিক নাম Macaca arctoides। বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন বানর প্রজাতিটি এদেশে এখন তথ্য অপ্রতুল শ্রেণিতে রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এরা ভারতের সাত রাজ্য (আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাম), মিয়ানমার, চীন, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বাস করে।

প্রাপ্তবয়স্ক খাটোলেজি বানরের দেহের দৈর্ঘ্য ৪৮.৫-৬৫ সেন্টিমিটার ও লেজ ৩.২-৬.৯ সেন্টিমিটার; ওজন ৭.৫-১০.২ কেজি। মুখমণ্ডল উজ্জ্বল গোলাপি বা লাল, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় হয়ে প্রায় কালো রং ধারণ করে। এ ছাড়া সূর্যের আলোতেও কালো হতে পারে। লম্বা, ঘন ও গাঢ় বাদামি লোমে পুরো দেহ আবৃত থাকে, তবে মুখমণ্ডল ও খাটো লেজটি লোমশূন্য থাকে। সদ্য জন্মানো বাচ্চার রং সাদা; বয়স বাড়ার সঙ্গে যা গাঢ় হয়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দাড়ি থাকে।

এরা আর্দ্র ও মিশ্র চিরসবুজ বনের গহিনে বাস করে। যদিও চার যুগের বেশি সময় ধরে এদের এদেশে দেখা যায়নি। তারপরও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম এবং মিয়ানমার সংলগ্ন সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের গভীর বনে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। দিবাচর, বৃক্ষবাসী ও ভূমিচারী এই বানরগুলো লাজুক হলেও ভীতু নয় মোটেও। এরা পুরুষ, স্ত্রী, বাচ্চাসহ ৫ থেকে ৬০টির দলে বাস করে। মূলত ফলখেকো হলেও বীজ, ফুল, পাতা, শিকড়, মিঠাপানির কাঁকড়া, ব্যাঙ, পাখি, পাখির ডিম, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খায়।

সচরাচর অক্টোবর থেকে নভেম্বরে প্রজনন করে। স্ত্রী বানর চার বছর বয়সে প্রজনন উপযোগী হয় ও প্রায় ১৭৭ দিন গর্ভধারণের পর একটি বাচ্চা প্রসব করে। স্ত্রী বানর ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত প্রজননক্ষম থাকে। যদিও প্রকৃতিতে এদের আয়ুস্কাল ১০-১২ বছর, তবে আবদ্ধাবস্থায় ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।