ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তাকে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা 'ঘুষ' দেওয়া হয়েছে- এমন একটি কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সমকালের হাতে এসেছে। সেখানে এক নারী বলছেন, 'এক কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই, আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না?' অপর প্রান্তে থাকা পুরুষ কণ্ঠও টাকা কোনো এক স্যারকে দেওয়ার কথা বলছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারী কণ্ঠটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এসআই মো. আকসাদুজ্জামানের স্ত্রী তহমিনা আক্তারের। রাজধানীর বিমানবন্দর থানার একটি ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ছাড়ানোর জন্য ওই টাকা দেওয়া হয় বলে দাবি করা হচ্ছে। সিআইডির ওই কর্মকর্তা সমকালের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তার দাবি, অপর প্রান্তের কণ্ঠটি ডিবির উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কায়সার রিজভী কোরায়েশীর।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার সমকালকে বলেন, অডিওটি একমুখী, কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে। তবু বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ওই মামলাটিরও তদন্ত চলছে। একটি চক্র ডিবির নাম ভাঙিয়ে ডাকাতি-ছিনতাই করে আসছিল। এতে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। তা ছাড়া ওই পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় এত টাকা কীভাবে এলো, সেটাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, গত বছরের ১৯ অক্টোবর সকালে দুবাইপ্রবাসী রোমান মিয়া ও তার ফুফাতো ভাই মনির হোসেন সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন। পথে বিমানবন্দর সড়কের কাওলা ফুট ওভারব্রিজ এলাকায় একটি মাইক্রোবাস তাদের গতিরোধ করে। গাড়ি থেকে নেমে আসা দু'জন ডিবি পরিচয়ে দুই ভাইয়ের নাম-ঠিকানা জানতে চায়।
পরে তাদের লাগেজসহ জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। হাতকড়া পরিয়ে তাদের মারধর করে সঙ্গে থাকা মার্কিন ডলার, দিরহাম, মোবাইল ফোন, কাপড়ভর্তি লাগেজসহ চার লাখ ৭৮ হাজার টাকার মালপত্র কেড়ে নেয় তারা। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা হয়। পরে তা তদন্ত করে ডিবি। একপর্যায়ে ছিনতাইয়ে জড়িত অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে মোশাররফ হোসেন নামে একজন সমকালকে বলেন, ২৬ নভেম্বর বিকেলে শান্তিনগর এলাকা থেকে আমাকে আটক করেন সাদা পোশাকে থাকা ডিবি কর্মকর্তারা। পরে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে আগে থেকে আটক ছয়-সাতজনকে দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয়, তাদের চিনি কিনা? তাদের চিনতে পারিনি বলে জানাই। কিন্তু এক কর্মকর্তা গালাগাল করে বলেন, আমি নাকি ছিনতাই করেছি। পরে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে ডিবি কর্মকর্তারা জানান টাকা দিতে হবে। আটক সাত-আটজন মিলে দুই কোটি টাকা দিতে বলা হয়।
তিনি আরও বলেন, একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে আমরা মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি ৩৩ লাখ ও সেলিম নামে একজন আমার চেয়েও বেশি টাকার ব্যবস্থা করেন। আটক অন্যদের মধ্যে আমির হোসেন তালুকদার, রিজু মিয়া, গোলাম মাওলা ও রিপন মোড়ল বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দেন। সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুজ্জামান আমার পূর্বপরিচিত। আটকের পর সহায়তার জন্য তাকে ফোন দিয়েছিলাম। তিনি এসে ডিবি কর্মকর্তা কায়সার রিজভী কোরায়েশীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন। পরে আটক অন্যরাও তাকে বিষয়টির মধ্যস্থতা করতে বলেন। এ নিয়ে ডিবি কর্মকর্তার সঙ্গে আকসাদুজ্জামানের বাগ্‌বিতণ্ডাও হয়। এর জের ধরে তাকেও আটকে রাখা হয়। শেষে তাকেসহ দু'জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমাদের পাঁচজনকে ২৯ নভেম্বর আদালতে হাজির করা হয়।
ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে মোশাররফ হোসেন বলেন, রংপুরের মডার্ন এলাকায় আমার গরুর খামার আছে। নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের কাজও করি। এ ছাড়া রাজধানীর মৌচাক টাওয়ারের নিচে স্টেশনারি দোকান আছে। সেখানে মাঝেমধ্যে মামলা-সংক্রান্ত কাগজ কম্পোজের জন্য আসতেন আকসাদুজ্জামান। তার বাড়ি ঠাকুরগাঁও। আমার বাড়ি রংপুর। একই এলাকার (উত্তরবঙ্গের) মানুষ হওয়ায় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তবে কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো মামলা-জিডি নেই।
অপরাধে সম্পৃক্ত না হলে এত টাকা দিলেন কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নির্যাতনের ভয়েই দ্রুত টাকার ব্যবস্থা করেছি।
এদিকে সিআইডির এসআই আকসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, আসামিদের ছাড়ানোর ব্যাপারে টাকা একত্র করে হস্তান্তরের কাজটি সমন্বয় করি। আমার খিলগাঁও এলাকার বাসায় গত ২৬ ও ২৭ নভেম্বর ওই টাকা দেওয়া হয়। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়েশী ও তার দলকে প্রথম দিন এক কোটি ২৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়। পরে আমার স্ত্রী তহমিনা আরও ১৪ লাখ টাকা দেন। কারণ বাগ্‌বিতণ্ডার কারণে আমাকেও ডিবি অফিসে আটকে রাখা হয়। ছিনতাইয়ের ঘটনায় সম্পৃক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানোর ভয় দেখানো হয়। ফলে স্ত্রী ওই টাকা দেন। পরে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে ডিবি আমার ইউনিটকে (সিআইডি) জানায়, ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে আমার সংশ্নিষ্টতার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। টাকা দেওয়ার পরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখানোয় ওই ব্যক্তিদের স্বজনরা আমার কাছে টাকা ফেরত চান। আমিও ডিবি কর্মকর্তার কাছে টাকা ফেরত চাই। এটা নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত হয়। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারের কাছে এ ব্যাপারে সুবিচার চেয়ে অভিযোগ দিয়েছি।
ডিবির উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়েশী সমকালকে বলেন, পুরো বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন। ওই অডিওটি ভুয়া, কণ্ঠ আমার নয়। টাকা নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তারা এই অডিও কৃত্রিমভাবে তৈরি করেছে।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে একটি বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য হাসান রাজা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে তিনি এসআই আকসাদুজ্জামানসহ জড়িত অন্যদের নাম বলেছেন। সিআইডির গাড়িচালক হারুন অর রশিদ সজীবও জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি জানান, সিআইডির ভাড়া নেওয়া গাড়ি দিয়েই ছিনতাই করা হয়। আকসাদুজ্জামান তাকে সেদিন গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিলেন। এই চক্রটি আগেও একাধিক ছিনতাই করেছে। আকসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধেও এর আগে ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
অবশ্য আকসাদুজ্জামান বলছেন, অপরাধে জড়িত থাকলে আমাকে গ্রেপ্তার না দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কেন? এখন তারা নানাভাবে টালবাহানা করছেন। তা ছাড়া ওই ব্যক্তি (হাসান রাজা) পরে আদালতে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। তাকে নির্যাতন করে জবানবন্দি আদায় করা হয়েছিল।
এদিকে একটি সূত্র বলছে, লেনদেন হওয়া অর্থের একটি বড় অংশই হুন্ডি কারবারিদের।
সেই কথোপকথন
তহমিনা :ভাই, আপনারে এত টাকা-পয়সা দিলাম, ১৪ লাখ, কিছু দিলে আমরা খরচপাতি করি।
পুরুষ কণ্ঠ :হুম। ওই যে এক কোটি ২৮ লাখ টাকা দিছেন, ওইটা নেওয়া যায় কিনা, দেখেন দেখি। আর এখানে (১৪ লাখের থেকে) চাইলে কিছু লাগলে কিছু দেবনি। একটু সময় দেন আমারে। কাল অফিস টাইমে কথা বলি?
তহমিনা :আমার ফোনটা একটু ধরিয়েন। দেশি মানুষ। আপনিই ভরসা।
পুরুষ কণ্ঠ :হুম। টাকাগুলো যে দিছেন ওইখানে স্যাররে, ওইটা বলব স্যার দেন, ওই লোকটারে যে এমন করলেন, টাকাগুলা দেন। ঠিক আছে? তাহলে কালকে কথা বলি আমরা, ওকে? কোনো সমস্যা হবে না।
তহমিনা :আপনি কী বুঝতেছেন, আপনি কিছু করতে পারবেন না?
পুরুষ কণ্ঠ :আপনার জামাই সব জানে, তার সাথে কথা বলে নিয়েন।
তহমিনা :না, আমি যে ব্যক্তিগতভাবে আপনারে ১৪ লাখ টাকা দিলাম, আপনি ওইটা থেকে কিছু ফেরত দিলে...
পুরুষ কণ্ঠ :আরে ভাই, আমাকে কোথায় টাকা দিলেন? এই টাকাগুলা তো সব ওখানে গেছে।
তহমিনা :আলাদা আমি দিয়ে আসলাম না যায়া?
পুরুষ কণ্ঠ :না না না, এগুলো সব ওখানকার টাকা। এগুলো সব সাক্ষাতে এসে কথা বলেন, বুঝায়ে দিচ্ছি আমি।
তহমিনা :শোনেন, আগের দিন যে আপনি নিছেন, সবাই মিলে।
পুরুষ কণ্ঠ :রাখেন, কোনো সবাই মিলে-টিলে না রে ভাই...
তহমিনা :ওই আপনারা যারা আসছিলেন...
পুরুষ কণ্ঠ :আচ্ছা সাক্ষাতে কথা বলি, এগুলো নিয়ে সাক্ষাতে কথা বলি। কালকে আসেন, অফিসে। এগুলো স্যারদের বলেন। আমি নিজেও তো বলছি।
তহমিনা :শোনেন, আপনি আমার দেশি মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ১৪ লাখ টাকা দিছি না?
পুরুষ কণ্ঠ :না না, ব্যক্তিগত কিছু নাই, এগুলা সব ওইখানকার টাকা। সাক্ষাতে কথা বলেন, কেন এগুলা নিবার পরে মামলা-টামলা হলো, স্যারের সাথে কথা বলেন।
তহমিনা :এক কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই, আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না?
পুরুষ কণ্ঠ :ঠিক আছে রাখেন।

বিষয় : 'ঘুষের' একটি অডিও

মন্তব্য করুন