
কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর চরের সেই খ্যাঁকশিয়াল ছানাটি- এসআই সোহেল
'রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে/ খ্যাঁকশিয়ালের বে (বিয়ে) হচ্ছে'- ছড়াটির আসলেই কিছু বাস্তবতা আছে। এ রকম পরিবেশে খ্যাঁকশিয়াল ও তাদের ছানাদের মনে আনন্দ-ফুর্তি জেগে ওঠে, হুড়োহুড়ি-দৌড়াদৌড়ি খেলায় মাতে। এমন পরিবেশে দু-পাঁচবার ওদেরকে বেজায় উল্লসিত হতে দেখেছি আমি। এ রকম পরিবেশ দেখা যায় শরৎ-হেমন্তে। কিন্তু ওই সময়টা খ্যাঁকশিয়ালের প্রজনন মৌসুম নয়। তবে খেলাচ্ছলে মিলন প্রক্রিয়ায় রত হতে দেখা যায়। ছানারাও খেলাচ্ছলে এ রকম খেলায় মাতে।
কিন্তু 'রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে' পরিবেশে কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা এসআই সোহেল 'খ্যাঁকশিয়ালের বিয়ে' দেখতে না পারলেও দেখেছিলেন তিনটি ফুটফুটে সুন্দর ছানাকে। রোদ ছিল, বৃষ্টিও পড়ছিল ঝিরঝির করে; ছানা তিনটিকে খেলায় মত্ত অবস্থায় দেখতে পান। অনেকক্ষণ চোখ-মন ভরে তিনি খেলা দেখেন, তারপর সামনে এগোতেই দুটি ছানা দৌড়ে কাশবনের ভেতর ঢুকে যায়। একটি ছানা অবাক-কৌতূহলে কাশবনের প্রান্তে বসে দেখতে থাকে সোহেলকে। তার ধারণা, এর আগে এই ছানারা মানুষ দেখেনি। ছবি তুললেন। এসআই সোহেল একজন বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক, পরিবেশবিদ। কিছুদিন আগে তিনি 'প্রকৃতি ও পাখি' ভ্রমণে কুষ্টিয়া শহর থেকে বেরিয়ে পড়েন। গড়াই নদীর ওপরের 'শেখ রাসেল সেতু' পার হয়ে দুই কিলোমিটার দূরের গড়াই নদীর বিস্তীর্ণ চরে গিয়ে পৌঁছান। ওখানেই শালদহ গ্রাম- গ্রামটি ও চরের অবস্থান হাতশ হরিপুর ইউনিয়নভুক্ত। ওখান থেকে তিনি বহু বছর ধরে নানা রকম পাখি ও বন্যজন্তুর ছবি তুলেছেন। পুরো কুষ্টিয়া জেলাসহ আশপাশের বন্যপ্রাণী ও পাখির 'হটস্পট'গুলো মুখস্থ তার। ওই এলাকায় শিয়াল-খ্যাঁকশিয়াল-শজারু-বুনো খরগোশ দেখা যায় আজও। আছে বাংলাদেশের বুনো-কোয়েলের (Barred Button-quail) দল। বাগেরহাটে এই বুনো-কোয়েলের নাম 'নাগরবাটোই'। সবচেয়ে বড় কথা, এই সোহেলই বছর কয়েক আগে কুষ্টিয়া থেকে ছোট বুনো-কোয়েলের (Small Button-quail) ছবি তুলে রেকর্ড করেছিলেন- তার আগে বাংলাদেশের আর কেউ ছোট বুনো-কোয়েলের ছবি তুলতে পারেননি। এটিও বাগেরহাট এলাকায় স্বল্পসংখ্যায় টিকে আছে। ওই রেকর্ড ছবিটি আমার একটি বইয়ে ছাপানোর জন্য সোহেলের কাছে চাই, দেরি না করে তিনি ছবিটি দেন সানন্দে। বইটি বেরোয় ২০১৬ সালে। তার তোলা খ্যাঁকশিয়ালের ছবিও ওই বইটিতে ছাপা হয়। তার সঙ্গে হৃদ্যতা আমার বহু বছরের।
সম্প্রতি খ্যাঁকশিয়ালের ছানার ছবি চাইতেই তিনি পাঠিয়ে দিলেন। প্রায় ২০ বছর বাদে খ্যাঁকশিয়ালের ছানা দেখে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি, চোখে এলো জল। হায়রে দুষ্টুমিষ্টি চেহারার ছানা! শৈশব-কৈশোর ও তরুণবেলা পর্যন্ত আমরা দশ/পনেরোজন বন্ধু মিলে কতই না জ্বালিয়েছি তোদের! ১৯৭০ পর্যন্ত আমার গ্রাম তো বটেই, আশপাশের গ্রামগুলোতেও প্রতি মৌসুমে খ্যাঁকশিয়ালরা খোলা মাঠের ভেতর বহুমুখী 'দুর্গ-বাসা' বানাত মাটিতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে। আট-দশটি সুড়ঙ্গমুখ মিলত গিয়ে মাটির তলায় একই পয়েন্টে- যেখানে ওদের মূল আশ্রয়স্থল ও আঁতুড়ঘর। আমাদের তো বিশ্বাস- খ্যাঁকশিয়ালরা মস্ত বড় মাটি-বিজ্ঞানী ও আর্কিটেক্ট। অভিজ্ঞ প্রকৌশলী। না হলে পরিকল্পিত-নিরাপদ এমন দুর্গ বানায় কীভাবে? আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি কোদাল-খুন্তি দিয়ে মাটি খুঁড়ে দুর্গের মূল চেম্বারে পৌঁছাতে- সাত থেকে বিশ বছর বয়সে মাত্র তিনবার সফল হয়েছিলাম, চেম্বার পেয়েছিলাম। চোখ না ফোটা ছানা এনে ফিডারে গরু-ছাগলের দুধ খাইয়েও বাঁচাতে পারিনি একটি ছানাকেও। তবে আমরা বিস্মিত হয়েছি ওদের পরিকল্পনা ও কৌশল দেখে। ওরা অঙ্ক-বিজ্ঞান সবই জানে। প্রায় আট ফুট বাই আট ফুট জায়গাজুড়ে বৃত্তাকারে দুর্গ বানানোর পরিকল্পনা করে প্রথমে। সুড়ঙ্গ খোঁড়ে কমপক্ষে আটটি (বেশিও খোঁড়ে), জ্যামিতির সূত্র মেনে। আমরা দেখেছি- বহুবারই দেখেছি পৌষ-মাঘে যখন আমন ধান কাটা হয়ে গেছে, তখনই আগাম খুঁড়েছে সুড়ঙ্গ। বালু মাটিই বেশি পছন্দের। আগাম দুর্গ বানানোর কারণ হলো, মাটি নরম থাকতে থাকতে সহজেই সুড়ঙ্গ খোঁড়া যায়। এদের ভরা প্রজনন মৌসুম বসন্তকাল থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। এ সময় মাঠ-ঘাট, ভিটি জমি, ঝোপঝাড়-কাশবন-ঘাসবন শুকনো খটখটে হয়ে যায়। আমার গ্রামের মাঠ ও ঝোপজঙ্গলবেষ্টিত ভিটি জমিগুলোতে প্রতিবছর গড়ে ১০টি দুর্গের সন্ধান আমরা পেতাম। আমাদের প্রবল নেশাওয়ালা খেলা ছিল খ্যাঁকশিয়ালদের তাড়া করা। আমার পোষা কুকুর সংকর জাতের টাইগার ও তার ভাই কালু মিলে বহুবারই খোলা মাঠে ধাওয়া করেছে- ধরি ধরি অবস্থা যখন, তখন পাঁই করে ডানে বা বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে দ্রুতবেগে। আর টাল সামলাতে না পেরে কুকুর দুটো মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। নিশাচর এই প্রাণীরা দিনভর দুর্গে শুয়ে ঘুমায়-ঝিমায়। দিনে বেরোলে বুঝতে হবে, বাসায় ছানা আছে। আমুদে-খেলুড়ে ও রসিক খ্যাঁকশিয়ালরা জানে, কুকুররা তাদের কচুটিও করতে পারবে না। আত্মরক্ষার নানা রকম কৌশল জানা আছে ওদের।
মূলত খোলা মাঠ, চর ও ভিটি জমির বাসিন্দা এরা। বর্ষাকালে কবরস্থান ও বন-বাগানে আশ্রয় নেয়। আমাদের বিচারে শিয়াল যদি হয় পণ্ডিত, তাহলে খ্যাঁকশিয়াল হলো মহাপণ্ডিত। যুক্তি আছে এর পেছনে। আমার ভাষায়, খুদে পণ্ডিত। এদের গর্ভধারণকাল ৫০-৫৩ দিন। ছানারা জন্মের সাত থেকে দশ দিনের মাথায় সুড়ঙ্গমুখে উঠে বসে থাকে, অবাক-বিস্ময়ে দেখে চারপাশটা, অল্পতে ভয় পেয়ে সুড়ূৎ করে ভেতরে। একটু বাদে দেখা যায়, আরেকটি সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আহারে খ্যাঁকশিয়ালের ছানা! কী রকম সুন্দর যে! কাচের মার্বেলের মতো চোখ। হাসি হাসি চেহারা। ফণিমনসার পাতার মতো লম্বা দুটি কান। চোখা মুখ। কাশফুলের মতো লোমশ লেজ। কৌতুক-কৌতূহলী চাহনি। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, প্রকৃতির শোকেসে রাখা আছে জীবন্ত 'শোপিস'।
রাতে বা সন্ধ্যায় ঘরে শুয়ে-বসে মাঝেমধ্যে শুনতাম- 'ফেউ ফেউ' স্বরে ডাকছে খ্যাঁকশিয়াল। মুরব্বিরা বলতেন, 'ফেউ শিয়াল' ডাকছে। এর অর্থ, বাঘ দেখে আশপাশের সব প্রাণীকে সতর্ক করে দিচ্ছে শিয়ালটি। একটু বড় হয়ে বুঝলাম- 'পেছনে ফেউ লেগেছে' কথাটির অর্থ! হয়তো বহু বছর আগে বাঘ দেখে এভাবে ডাকত খ্যাঁকশিয়ালরা। এখন ডাকে মেছোবাঘ বা খাটাশ দেখে। তবে এ কথা ঠিক, শত্রুকে এলাকা থেকে হটিয়ে দূরে সরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত থেমে থেমে 'ফেউ ফেউ' শব্দে ডেকেই চলবে। অনুসরণ করবে। দুর্গে ছানা থাকলে তো ডাকবেই, না থাকলেও ডাকবে। নাছোড়বান্দা। চৈত্র-বৈশাখে বারকয়েক আমরা খ্যাঁকশিয়ালকে 'কাঁপুনি রোগে' আক্রান্ত হতে দেখেছি- পোষা বিড়াল ও বনবিড়াল এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রকম ক্ষেত্রে এলোমেলো হাঁটে, কাত হয়ে পড়ে যায় বারবার। এ রকম ক্ষেত্রে কুকুরও এড়িয়ে চলে ওদের। ছোঁয়াচে রোগ! কুকুররা এড়িয়ে চলে পাগলা শিয়াল-কুকুরকেও। ওরা বোঝে, ওদের কামড় খেলে কুকুর নিজেও পাগল হবে। কাঁপুনি রোগের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন প্রাণিচিকিৎসক তথা বন্যপ্রাণী চিকিৎসকরা। মহা দৌড়বিদ খ্যাঁকশিয়ালরা যে দৌড় প্রতিযোগিতায় দেশি রেসের ঘোড়াকেও হারিয়ে দিতে পারে, তার প্রমাণ আমরা বাস্তবে দুবার পেয়েছি।
কাঁকড়ার গর্তে লেজ ঢুকিয়ে দিয়ে নাকি কাঁকড়া শিকার করে পাতিশিয়ালরা। দেখিনি কোনো দিন, শুধু শুনেছি। কিন্তু খ্যাঁকশিয়ালরা যে এই কাজটি করে, তা আমরা একাধিকবার দেখেছি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন আমরা রাতে বন্দুক হাতে (সবাই ২০/২৫ বছর বয়সী) মাঠ-বাগানে থাকতাম, ঘুরতাম। এক রাতে শুনি একটি খ্যাঁকশিয়াল ছানার করুণ কান্না। পাঁচ সেলের টর্চ ফেলে দেখি, একটি ছানার নাক-মুখ কাঁকড়ার সাঁড়াশির কবলে পড়েছে! সে কী লম্ম্ফঝম্ম্ফ আর চেঁচামেচি! ভয়ংকর সুন্দর দৃশ্য ছিল সেটা। প্রসঙ্গত বলতে হয়, লেজ কাঁকড়ার গর্তে ঢোকালে কাঁকড়া তার সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরে লেজ, খ্যাঁকশিয়াল তখন ঝটকা লাফে দূরে গিয়ে পড়ে। কাঁকড়াটি উঠে আসে ওপরে।
খ্যাঁকশিয়ালের মূল খাদ্য তালিকা হলো নির্বিষ সাপ-ছোট পাখি ও পাখির ডিম-ছানা-কেঁচো-কাঁকড়া-ইঁদুর-ব্যাঙ-কুঁচে-তলায় পড়া পাকা সফেদা-পেঁপে-আম-জাম-পাকা খেজুর-গিরগিটি-টিকটিকিসহ নানা রকম পোকামাকড়। তবে সুযোগ পেলে কমবয়সী ছাগল ছানা, ভেড়ার ছানা মারে। এরা কাত হয়ে চুপচাপ শুয়ে মরার ভান করে পড়ে তাকে। কৌতূহলী কোনো পাখি বা প্রাণী কাছে এসে পরখ করার সময় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ধরে ফেলে শিকার।
নানা কারণে- অনিবার্য কারণেই দেশ থেকে খ্যাঁকশিয়াল প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। মজার প্রাণী খ্যাঁকশিয়ালের ইংরেজি নাম Bengal Fox। বৈজ্ঞানিক নামvulpes bengalensis। দৈর্ঘ্য ৪৫-৬০ সেন্টিমিটার। ওজন ২৬-২৮ কেজি। এসআই সোহেল সেদিন সেই কাশবনে ঢুকে খ্যাঁকশিয়ালের দুর্গ দেখতে পেয়েছিলেন। সুড়ঙ্গমুখের বাইরে ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল মুরগির পালক, পাখির পালক ও সরু হাঁড়, কাঁকড়ার খোলস, ইঁদুরের লেজ ও ব্যাঙের ঠ্যাং। মা-বাবার আনা এসব খাবার খেয়েছে ছানাগুলো। ছানাগুলো খেলায় মেতেছিল ঠিক বিড়াল বা বন বিড়ালের ছানাদের মতো। সোহেলকে দেখেই না সাঙ্গ দিল মজার খেলা। না পারতে খ্যাঁকশিয়ালরা গেরস্থ বাড়ির হাঁস-মুরগির দিকে হাত বাড়ায় না। ক্লাস নাইনে যখন পড়ি আমি, তখন এক বিকেলে বাড়ির পাশে চরতে থাকা তিতির (গৃহপালিত হিসেবে দেশের নানা প্রান্তেই দেখা যায়) বা 'তিতপাখি' চরছিল সাতটি। এক ধাঁড়ি খ্যাঁকশিয়াল একটির ওপরে লাফিয়ে পড়তেই সব তিতির একযোগে আক্রমণ করে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল খুদে পণ্ডিতকে। লেজের একগুচ্ছ লোম ফেলে রেখে দিয়েছিল চম্পট। তিতির খুবই হিংস্র ও রাগী স্বভাবের পাখি। বুকভরা সাহস ওদের, চোখভরা রোষ। এদের ইংরেজি নাম Guinea Fowl।
বিষয় : প্রাণিজগৎ
মন্তব্য করুন