উপজেলা পরিষদ আইনে সরকারের ১৭টি বিভাগকে স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা এসব দপ্তরের কাজ বাস্তবায়নে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) সভাপতি ও চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করে পরিপত্র জারি করেছে। পরিপত্র পেয়ে উপজেলার প্রায় সব কাজে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ইউএনওরা। আর চেয়ারম্যানরা উপদেষ্টা হওয়ায় পরিষদে কার্যত তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিপত্রের মাধ্যমে ১৪০টি কমিটি তৈরি করে এগুলোর সভাপতি ও আহ্বায়ক করেছে ইউএনওদের। অথচ আইন অনুযায়ী এ দায়িত্ব পাওয়ার কথা ছিল নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের। ইউএনওরা উপজেলা পরিষদের বদলে নাম ব্যবহার করছেন উপজেলা প্রশাসন।
এমন পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার উপজেলা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত সব দপ্তরের কার্যক্রম পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে আইন, বিধি ও নোটিফিকেশন অনুসারে করার জন্য ইউএনওদের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, সরকারের ১৭টি বিভাগে কোনো কমিটি গঠন করা হলে সেটার সভাপতি হওয়ার কথা উপজেলা চেয়ারম্যানের। দীর্ঘদিন ধরে এসব দপ্তরের বিভিন্ন কমিটিতে পরিপত্রের মাধ্যমে ইউএনওদের সভাপতি করা হয়েছে। সম্প্রতি এর সংখ্যা আরও বেড়েছে। ফলে উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন আইন, বিধি ও নোটিফিকেশন অনুযায়ী ইউএনওদের চলতে হবে। এর ফলে আগের সব পরিপত্র বাতিল হয়ে যাবে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হওয়ার কথা উপজেলা চেয়ারম্যানদের। কিন্তু পরিপত্রের মাধ্যমে করোনার ত্রাণ বিতরণ, দুর্যোগ সাড়া প্রদান সমন্বয়, মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, অতিদরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার প্রকল্প যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ইউএনওদের। ফলে দরিদ্রদের বাছাই ও সহায়তার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করছেন ইউএনওরা। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে কার্যাবলি নিষ্পত্তির জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রায় ২০টি কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির সভাপতি বা আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন ইউএনও। আর উপজেলা চেয়ারম্যানদের করা হয়েছে উপদেষ্টা।
ঢাকার দোহার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন সমকালকে বলেন, এলাকায় কে দরিদ্র, কে গৃহহীন- এগুলো তো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার জানার কথা। আইন অনুযায়ী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান। কিন্তু যখনই কোনো কাজের সময় আসে, তখনই ইউএনওকে প্রধান করে নতুন কমিটি করা হয়। এতে বেশির ভাগ উপজেলায় সঠিক ব্যক্তিরা সরকারের সহায়তা পাচ্ছেন না। অনেক সময় আমরা জানিও না, কাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে।
কেরানীগঞ্জের ইউএনও অমিত দেবনাথ সমকালকে বলেন, চেয়ারম্যানরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের কর্মী। ভোটের বিষয়ও থাকে। এ জন্য তারা স্বজনপ্রীতি করতে পারে। ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য হয়তো মন্ত্রণালয় থেকে ইউএনওদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে দরিদ্র ব্যক্তি বাছাই ও ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন কাজে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা কাজ করেন। উপদেষ্টা হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যানদের পরামর্শ নেওয়া হয়।
আইনের সঙ্গে পরিপত্র সাংঘর্ষিক কিনা- এ বিষয়ে অমিত দেবনাথসহ প্রায় ২০ জন ইউএনও সমকালকে বলেন, আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া গেলে বিষয়টি বোঝা যাবে।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সমকালকে বলেন, সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের হয়তো এ আইন সম্পর্কে জানা নেই। তাই তারা পরিপত্র জারি করে ইউএনওদের কমিটির প্রধান করেছেন।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ সমকালকে বলেন, উপজেলা পরিষদে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম চলছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আইনের কিছু বিষয় ঠিক করা হয়েছিল। ২০১১ সালে আবার অনেক কিছু বাদ দিয়ে আইনটাকে দুর্বল করা হয়েছে। এ জন্যই হয়তো চেয়ারম্যানরা হাইকোর্টে রিট করেছেন। তারপরও উপজেলাতে যে ক্ষমতা আছে, সেটা অফিসাররা প্রয়োগ করছেন অন্যভাবে। অনেক চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান বোঝেন না বলে কাজ করতে পারেন না। এ জন্য দুই পক্ষেরই দোষ আছে।
তিনি বলেন, চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে- কর্মকর্তাদের অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স রিপোর্ট (এসিআর) লিখতে। চেয়ারম্যানরা কি সেটা লিখেছেন? বেশিরভাগ চেয়ারম্যান কর্মকর্তাদের এসিআর লিখতেই জানেন না। এ জন্য সবার গাফিলতি রয়েছে। সবাই শুধু টাকা আর ক্ষমতা খোঁজেন, কাজ করতে চান না।
ড. তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, এসব সমস্যা সরকারকেই সমাধান করতে হবে। হাইকোর্টে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ, হাইকোর্টের নির্দেশনা সরকারকেই প্রতিপালন করতে হবে।
উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, চেয়ারম্যানের অনুমোদন ছাড়াই সব কাজ কমিটিপ্রধানের ক্ষমতাবলে ইউএনও নিয়ন্ত্রণ করছেন। ইউএনও পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও মূলত তারাই আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। এটি আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন।
বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার সমকালকে বলেন, জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্দেশনা অমান্য সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাষ্ট্রীয় কর্মচারী রাষ্ট্র্রের প্রতিনিধি, উপজেলায় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করবে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ। কেবল সংসদ সদস্য আইনের ২৫ ধারায় উপদেষ্টা হবেন, সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যান কী করে উপদেষ্টা হন? জনপ্রতিনিধিদের আইন স্বীকৃত মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণ করছেন কর্মচারীরা। বাধ্য হয়ে একাধিক রিট পিটিশন করা হয়েছে।
তবে স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সমকালকে বলেন, চেয়ারম্যানরা একটা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করছেন, যাতে ইউএনওদের ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। ইউএনওদের নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তো হবে না। তিনি তো সরকারের প্রতিনিধি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের মতো নয়। ইউএনও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। চেয়ারম্যানরা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, ইউএনওরা সেখানে ভেটিংও দিতে পারবেন। এ জন্য সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রয়েছেন।
সমস্যা সমাধানে জটিলতা : উপজেলা পরিষদের সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১১ সালে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। কমিটিকে বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর সমাধানের জন্য একটি প্রস্তাব প্রেরণের জন্য বলা হয়। কিন্তু সেই কমিটি এর কোনো সমাধান করতে পারেনি। এখন শত শত পরিপত্রের মধ্যে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন হওয়া নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
উপজেলা পরিষদের সমস্যা সমাধানে গঠিত সেই কমিটির সদস্য এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, ২০১১ সালে উপজেলার সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করা হয়। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে পারস্পরিক ঐক্যের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদের আইন পরিবর্তনের চেয়ে মানসিক ঐক্যের প্রয়োজন অনেক বেশি। মানসিক মিল থাকলে স্বাভাবিক নিয়মেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।