বিদেশগামীদের ভুয়া সনদ দেওয়ায় যে চার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তার দুটিকে বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার কাজ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার ও স্টেমজ হেলথ কেয়ার (বিডি) লিমিটেড। বিমানবন্দরে করোনার র‌্যাপিড পরীক্ষার (আরটি-পিসিআর) ল্যাব স্থাপনের যে সাত প্রতিষ্ঠানের নাম প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সে তালিকার শীর্ষে রয়েছে এ দুই প্রতিষ্ঠানের নাম।
গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রস্তাব করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল বুধবার তাদের নির্বাচিত করে অফিস আদেশ জারি করেছে মন্ত্রণালয়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর তারা বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপন করবে।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরাতগামীদের করোনা পরীক্ষায় ল্যাব স্থাপনের কাজ চেয়ে যে ২৩ প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল, তার মধ্য থেকে গত সোমবার সাতটিকে প্রাথমিক তালিকায় রেখেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারিগরি কমিটি। তবে চূড়ান্ত প্রস্তাবে তার তিনটি বাদ পড়েছে, নতুন তিনটি যুক্ত হয়েছে।
চূড়ান্ত প্রস্তাবে নতুন যুক্ত হওয়া তিন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সোমবারের সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, তারা আবেদনপত্রে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়নি। কোন মেশিনে করোনা পরীক্ষা করবে, কত সময়ে রিপোর্ট দিতে পারবে- এসব তথ্য তাদের আবেদনে ছিল না। অপ্রতুল তথ্য থাকায় তাদের বিবেচনায় নেওয়া হয়নি প্রাথমিক তালিকায়। কিন্তু চূড়ান্ত প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করা হয়েছে।
এই তিন প্রতিষ্ঠান হলো- আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল, জয়নুল হক শিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল (প্রা.) লিমিটেড ও গুলশান ক্লিনিক লিমিটেড। প্রাথমিক সুপারিশ করা তালিকা থেকে বাদ পড়া তিন প্রতিষ্ঠান হলো- ল্যাবএইড হাসপাতাল, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস ও প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট।
প্রাথমিক সুপারিশে থাকা সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার, স্টেমজ হেলথ কেয়ার, এএমজেড হাসপাতাল লিমিটেড ও ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক চূড়ান্ত প্রস্তাবেও রয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. সারওয়ার আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিকিউর (এসওপি) মেনে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানকে বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের জায়গা বরাদ্দ করতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) এবং ল্যাবগুলোর কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অনুরোধ করা হয়েছে।
ভুয়া সনদ দেওয়ায় গত ১০ জুন সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার, স্টেমজ হেলথ কেয়ারের বিদেশগামীদের পরীক্ষা ও নমুনা সংগ্রহের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষার সরকার নির্ধারিত ফি আড়াই হাজার টাকা। সিএসবিএফ ও স্টেমজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা দালালের মাধ্যমে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা নিয়ে নমুনা পরীক্ষা না করেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নেগেটিভ রিপোর্ট দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়া কর্মীদের করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছিল। এর আগে দেশ থেকে নেগেটিভ সনদ নিয়ে বিদেশে গিয়ে পজিটিভ হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল।
যে সাত প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দরে করোনার র‌্যাপিড পরীক্ষার জন্য মনোনীত হয়েছে, তারা আগামী তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে ল্যাব স্থাপন করবে। টেস্ট-প্রতি এক হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কার্যাদেশ পাওয়ার ছয় দিনের মধ্যে ল্যাব স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া জয়নুল হক শিকদার সর্বনিম্ন এক হাজার ৭০০ টাকা চেয়েছে।
সর্বনিম্ন তিন দিনের মধ্যে ল্যাব স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া স্টেমজ হেলথ কেয়ার দুই হাজার টাকা চেয়েছে টেস্ট-প্রতি। প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাবে বলেছে, তারা অ্যাকুলার সিস্টেম পয়েন্ট মেশিনের মাধ্যমে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে টেস্টের রিপোর্ট দিতে পারবে।
সিএসবিএফ প্রস্তাবে বলেছে, একই সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিতে সক্ষম। কার্যাদেশ দেওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে ল্যাব স্থাপন করতে পারবে। টেস্ট-প্রতি এক হাজার ৮৫০ টাকা চেয়েছে। সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩০০ টাকা চাওয়া ডিএমএফআর চার দিনের মধ্যে ল্যাব স্থাপন করবে।
এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। ডিএমএফআর গত ২৯ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে দেওয়া বিস্তারিত প্রস্তাবে যে তথ্য দিয়েছে, তাতে ত্রুটি রয়েছে। এ কারণে কারিগরি কমিটি প্রতিষ্ঠানটিকে বাদ দিয়েছিল। কিন্তু টেস্ট-প্রতি সর্বোচ্চ টাকা দাবি করা এ প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক তালিকায় চলে আসে; কাজও পেয়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন সমকালকে বলেন, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে, তা যাচাই করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারিগরি কমিটি। তারা যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রস্তাব করেছে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদেরই ল্যাব স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। কে কবে কীভাবে ল্যাব স্থাপন করবে, এ বিষয়টি দেখভাল করবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
ভুয়া নেগেটিভ সনদ দেওয়ার কারণে করোনা পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দুই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে সচিবের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।
এদিকে প্রাথমিক সুপারিশের তালিকায় থেকেও বাদ পড়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, তাদের কোনো কারণ দেখানো হয়নি। একটি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ- যাদের পক্ষে তদবির ছিল এমন 'পছন্দের' প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকের পরীক্ষার সক্ষমতা নেই। তারা নির্ধারিত সময়ে ল্যাব স্থাপন করতে পারবে না। তবে এসব অভিযোগের সত্যতা সমকাল যাচাই করতে পারেনি। ল্যাবএইড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এএম শামীম বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠান দুই হাজার টাকা টেস্ট ফি প্রস্তাব করেছিল। কেন বাদ দেওয়া হয়েছে, জানেন না।
কর্মস্থলে ফেরার তাগিদে থাকা প্রবাসী কর্মীদের করোনার র‌্যাপিড পরীক্ষায় বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে দুটি পৃথক কমিটি করা হয়। স্বাস্থ্যসেবা সচিবের নেতৃত্বে মূল কমিটি রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বেও একাধিক সভা হয়েছে এ বিষয়ে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সময় স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য বিষয়ের মতো এ ক্ষেত্রে অনিয়মের নানা অভিযোগ আসতে শুরু করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. খুরশীদ আলম প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকা কারিগরি কমিটির প্রধান। তিনি সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনটি যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে। এগুলো হলো- কম খরচে, কম সময়ে বেশিসংখ্যক করোনা পরীক্ষা করতে পারবে কারা, তা বিবেচনা করে সাতটির নাম প্রস্তাব করেছে। মঙ্গলবারের সভায় ১৯টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়ে নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে জানিয়েছে। তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা সমকালকে বলেন, সিএসবিএফ ও স্টেমজের করোনা পরীক্ষার অনুমতি সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাদের কার্যক্রম পরিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে আবারও করোনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। এখন আর তারা বাতিলের তালিকায় নেই।
ভুয়া সনদ দেওয়ার কারণে শাস্তি পাওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। তবে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রী নিজেও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। তিনি কর্মকর্তাদের বলেছেন, কী কী যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হবে, তা আগেই ঠিক করে দেওয়া উচিত ছিল।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার আমিরাতের শর্তানুযায়ী, যাত্রার ৪৮ ঘণ্টা আগে পিসিআর টেস্টে নেগেটিভ ফল এলে বিমানবন্দরে প্রবেশ করে বিমান উড্ডয়নের ছয় ঘণ্টা আগে র‌্যাপিড টেস্ট করতে হবে। তাতে নেগেটিভ ফল এলে যাত্রা করতে পারবেন আমিরাতগামীরা। কিন্তু বিমানবন্দরে করোনার র‌্যাপিড পরীক্ষার সুবিধা না থাকায় গত ১৩ মে থেকে কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না ৪০ থেকে ৫০ হাজার আমিরাতপ্রবাসী। ল্যাব স্থাপনের দাবিতে তারা প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলন করছেন।
গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে দু-তিন দিনের মধ্যে বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বাছাই করতেই ১০ দিন লেগেছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, শুরুতে বেসরকারি একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এতেই সময়ক্ষেপণ হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, সিন্ডিকেট ঠেকাতে নানামুখী চাপ অগ্রাহ্য করে একটির পরিবর্তে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভুয়া সনদ দিলে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আমিরাতেও বাংলাদেশি নাগরিকের প্রবেশ নিষিদ্ধ হতে পারে। করোনার তৃতীয় ঢেউ আসার আশঙ্কা রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক দেশ বিমান উড্ডয়নের আগে র‌্যাপিড টেস্টের শর্ত দিতে পারে। এতে আগামী কয়েক বছর ধরে বিমানবন্দরে পরীক্ষার কাজ চলতে পারে।