আলোচিত ৪৯ মামলার আসামি একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ করেছেন তার মা কমরের নেহার। তিনি বলেছেন, তার মেঝ ছেলে একরামুল আহসান নিজের মায়ের সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে অন্য নারীকে মা বানিয়ে জাল দলিল তৈরি করেছেন। এমনকি তার মায়ের বিরুদ্ধে দুটি এবং ভাই-বোনদের বিরুদ্ধে আরও ১৪টি মামলা করেছেন।

বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের আকরাম খাঁ হলে এক সংবাদ সম্মেলনে কমরের নেহার এসব কথা বলেন। ৮৪ বছর বয়সী কমরের নেহারের পক্ষে তার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান মেয়ে ফাতেমা আক্তার। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- কমরের নেহারের বড় ছেলে আক্তারী কামাল এবং কাঞ্চনের মামাতো ভাই শাকেরুল কবির ও তার দুই বোন।

কমরের নেহার সপরিবারে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ। এই দিল্লুর রহমান ও তার সিন্ডিকেটের দায়েরকৃত ৪৯ মামলার আসামি হয়ে একরামুল আহসান কাঞ্চন দীর্ঘদিন ধরে হয়রানি হচ্ছেন। এ নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল করলে গত ১২ সেপ্টেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, 'পীর সাহেবের কাণ্ড দেখেন! একটা পীরের সিন্ডিকেট কীভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করে। জায়গা-জমি দখলের জন্য পীর সাহেবরা অনুসারী-মুরিদ দিয়ে কী করে দেখেন!'

সংবাদ সম্মেলনে কমরের নেহার বলেন, তার স্বামী ডা. আনোয়ার উল্লাহসহ তিনি ও তার ছেলেমেয়েরা ১৯৮৬ সালে ঢাকার রাজারবাগ দরবার শরীফে বাইয়াত গ্রহণ (মুরিদ হওয়া) করেছিলেন। আর মেঝ ছেলে একরামুল আহসান কাঞ্চন ১৯৯৫ সালে জাপান থেকে ফিরে সেখানে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ডা. আনোয়ার উল্লাহ আর্থিকভাবে সামর্থবান হওয়ায় অনেক জমিজমা কিনেছিলেন। তার মৃত্যুর পর পর এই সম্পত্তি কাঞ্চনসহ সবার মধ্যে বণ্টন হয়। তার স্বামী তার জন্য আলাদাভাবে কিছু সম্পত্তি কিনেছিলেন- যা দিয়ে স্বামীর অনুকরণে মাদরাসা ও ইয়াতিমখানা করার ইচ্ছা পোষণ করায় তার মেঝ ছেলে একরামুল আহসান কাঞ্চনের সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। ওই বছরই ওই সম্পত্তি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে অন্য নারীকে মা বানিয়ে তার নামে জমির জাল দলিল তৈরি করেন কাঞ্চন।

তিনি আরও বলেন, তার স্বামীর সম্পত্তির সব দলিলপত্র কাঞ্চনের কাছেই জমা থাকতো এবং তাকে পরিবারের লোকের বিশ্বাসও করতেন। কিন্তু অন্য নারীকে মা বানিয়ে জাল দলিল তৈরির পর অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেড়িয়ে আসে। দেখা যায়, প্রায় এক যুগ আগেই কাঞ্চন তাকে মৃত দেখিয়ে এবং তার একমাত্র বোন ফাতেমা আক্তারকে বাদ দিয়ে ওয়ারিশনামা তৈরি করেছেন। কাঞ্চনের বানানো জাল দলিল বাতিল এবং তার মেয়ের ওয়ারিশস্বত্ব ফিরিয়ে আনতে আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি। এতে কাঞ্চন ক্ষিপ্ত হয়ে তার ও তার ছেলেমেয়েদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিতে শুরু করেন। গর্ভধারিনী মা হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে দুটি, আপন বড় ভাই আক্তারী কামালের বিরুদ্ধে সাতটি, বোন ফাতেমা আক্তারের বিরুদ্ধে তিনটি এবং তার মামাতো ভাই শাকেরুল কবিরের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেন।

কমরেরে নেহারের অভিযোগ, তিনি তার কোনো সম্পত্তিই রাজারবাগ দরবার শরীফের পীরকে লিখে দেননি। ২০১৪ সালে নিজের অংশ থেকে মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ মাদ্রাসার নামে ৭৬ শতাংশ জমি দান করেন। এই দানও ছিল মাদ্রাসা ও ইয়াতিমখানার জন্য, পীর বা দরবার শরীফের নামে নয়। অথচ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যেন ওই দানের জমি গ্রহণ না করেন, সেজন্য কাঞ্চন রাজারবাগ দরবার শরীফ ও মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ মাদ্রাসার সংশ্লিষ্ট লোকজনের ওপর মামলা-হামলা করতে থাকেন। অনেককে রক্তাক্ত করে হাসপাতালেও পাঠান। মাদ্রাসায় যাওয়া বোরকা পরিহিতা নারীদেরও কাঞ্চন উত্ত্যক্ত করতেন। কিছুদিনের মধ্যে কাঞ্চনের আচরণ এতটাই উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে যে, লজ্জায় পড়ে যান তিনি ও তার পরিবার। মিডিয়ায় তাকে 'পাগল' আখ্যা দিয়ে তার ও ছেলেমেয়েদের নামে কাঞ্চন আবোল-তাবোল অনেক কিছুই বলেছেন, যার কোনটাই সত্য নয়।

মিডিয়া ও প্রশাসনের উদ্দেশ্যে কাঞ্চনের মা বৃদ্ধা কমরেরে নেহার আরও বলেছেন, 'আপনারা দয়া করে আমার ছেলে কাঞ্চনের এই অসৎ কর্মে সহায়তা করবেন না। কাঞ্চন আমার দান করা জমি কেড়ে নিতে পারলে, সেখানেই থেমে থাকবে না। একটা সময় তার আপন ভাই-বোনদের সম্পত্তির দিকেও হাত বাড়াবে। কারণ ইতিমধ্যে ওয়ারিশনামায় সে তার একমাত্র বোনকে বঞ্চিত করেছে, জাল হেবায় বড় ভাইকে বঞ্চিত করেছে। এছাড়া ঢাকার শেওড়াপাড়া ও নারায়ণগঞ্জের ফ্যাক্টরির জমি থেকে ছোট ভাইকে বঞ্চিতকরেছে। সুযোগ পেলে ভাই-বোনদের পুরো সম্পত্তিও সে গ্রাস করবে। আমি চাই, প্রত্যেকেই যেন তার প্রাপ্য জমির হক বুঝে পায়। আমার ছেলে-মেয়ে এবং নাতি-নাতনিদের ওসিয়ত করে যাচ্ছি, আমার মৃত্যুর পরও যেন আমার দান অক্ষত থাকে এবং সেটা যেন মাদ্রাসা ও এতিমখানার কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়।'

ছেলের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অভিযোগ পাঠের পর কমরের নেহার ও তার পরিবারকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে চাইলে তারা জানান, কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে তারা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেননি। তারা শুধু তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এরপরও কাঞ্চনের জাল হেবা দলিল সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোনো উত্তর না দিয়ে সংবাদ সম্মেলনস্থল ছাড়েন।

অভিযোগ অস্বীকার কাঞ্চনের: মা কমরের নেহার ও পরিবারের সব অভিযোগ অস্বীকার করে একরামুল আহসান কাঞ্চন সাংবাদিকদের বলেন, তার মা-ভাই-বোন রাজারবাগ দরবার শরিফের পীরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার বিরুদ্ধে এই সংবাদ সম্মেলন করেছেন। পীরের কয়েকজন সহযোগী মাদ্রাসার দানের বাইরেও তাদের আরও জায়গা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছিল। এটা বুঝতে পেরে বাধ্য হয়ে তিনি তার মায়ের কাছ থেকে গোপনে স্বাক্ষর নিয়ে নারায়ণগঞ্জের ১৭১ শতাংশ জায়গার হেবা দলিল তৈরি করেন। পীরের মুরিদ হওয়ায় তার মা ও ভাই-বোন ওই সম্পদ পীরকে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় এই কাজ করেছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমার যদি সম্পদের প্রতি লোভ থাকত তাহলে তো সব আমার নিজ নামেই নিতাম। আমার ছোট ভাই আর ভাতিজাদের নাম রাখতাম না।'

মাকে মৃত দেখিয়ে বোনের অংশ বাদ দিয়ে ওয়ারিশনামা তৈরির অভিযোগ সম্পর্কে কাঞ্চন বলেন, 'এটাও সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। যদি এমনটা হতো তাহলে তো আমার মা আমার বিরুদ্ধে মামলা করতেন। তাদের জিজ্ঞেস করেন মামলা কেন করলেন না।'

বিষয় : একরামুল আহসান কাঞ্চন ৪৯ মামলার আসামি

মন্তব্য করুন