ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনার জন্য আগাম টাকা পরিশোধ করে প্রতারিত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। তারা সময়মতো পণ্য বা টাকা কোনোটাই পাননি। এখন পরিশোধ করা টাকা বা সরবরাহ করা পণ্যের মূল্য ফেরত পাবেন কিনা, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। কারণ, এসব বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা গ্রেপ্তারের পর তাদের কর্মকাণ্ডের দায় কেউই নিতে চাইছে না। যদিও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতিমালা প্রণয়নে কাজ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তা অধিকার রক্ষায় রয়েছে নির্দিষ্ট অধিদপ্তর। অস্বাভাবিক লেনদেন এবং পরিশোধ ব্যবস্থা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার ই-ক্যাব নামে এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠনও আছে। কিন্তু কোনো পক্ষই ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ অন্যান্য পঞ্জি স্কিম পরিচালনাকারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের পাওনা টাকা ফেরতের কোনো পথ দেখাতে পারছে না।

সরকারি সংস্থাগুলোর বক্তব্য, ইভ্যালিসহ কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসার যে মডেল অনুসরণ করেছে, তাতে বড় ধরনের ঝুঁকি ছিল এবং এতে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বেশিসংখ্যক ক্রেতা থেকে টাকা নিয়ে ব্যাপক ছাড়ে কমসংখ্যক ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করে মানুষকে প্রলুব্ধ করার মাধ্যমে প্রতারণা করেছে এসব প্রতিষ্ঠান। এটি প্রচলিত আইনে অপরাধ। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের অপরাধের দায়িত্ব সরকার বা কোনো সংস্থা নেবে না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নয়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক সংযোগ সৃষ্টি করা মন্ত্রণালয়ের কাজ। কোনো ব্যবসা খাতের জন্যই আলাদা নিয়ন্ত্রণ কাঠামো নেই। দেশে কোম্পানি নিবন্ধন, পণ্য ও খাদ্যমান, ভোক্তা অধিকার, প্রতিযোগিতা এবং সুষ্ঠু লেনদেন নিশ্চিত করার জন্য আলাদা আলাদা সংস্থা কাজ করছে। এ ছাড়া শৃঙ্খলা নিশ্চিত করাসহ প্রচলিত অন্যান্য আইন বাস্তবায়নে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ। ক্রেতা বা ব্যবসায়ী যদি মনে করেন তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তাহলে এসব সংস্থার কাছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে কোনো কোম্পানির দায়দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিতে হবে, বিষয়টি তেমন নয়।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ একদিনে লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। কয়েক বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠান প্রকাশ্যে ব্যাপক ছাড়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবসা করে আসছে। বিপুল খরচ করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের স্পন্সর হিসেবে অংশ নিয়েছে ইভ্যালি। এখন যারা বলছে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা পদ্ধতি টেকসই নয় বা প্রতারণামূলক পঞ্জি স্কিম পদ্ধতি, তাহলে দেশের কোনো কর্তৃপক্ষ শুরুতে কেন বন্ধ করেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন কারণে আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডেসটিনি, যুবকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। যে কারণে অন্যরাও একই ধরনের প্রতারণার উদ্যোগ নেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। এ ছাড়া ই-কমার্স খাতে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিতেও দেরি হয়েছে।

ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, নিরাপদ ডটকমসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দেশের কয়েক লাখ গ্রাহকের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এর মধ্যে ইভ্যালির কাছে রয়েছে এক হাজার কোটি এবং ই-অরেঞ্জের কাছে ১১শ কোটি টাকা আটকে আছে। এসব গ্রাহকের মধ্যে যেমন আছেন ক্রেতা শ্রেণি, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের সরবরাহকারী কোম্পানি। সরবরাহকারীরা বাকিতে পণ্য দিয়ে টাকা পায়নি। এ ছাড়া রয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানের মার্কেট প্লেস ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করা দেশের ছোট ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রথমত ই-কমার্সগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে বা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে না। ফলে এ খাতে কোথায় কী হচ্ছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত জানা থাকার কথা নয়। যখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট তদন্ত করার অনুরোধ করেছে বা গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যতটা উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ আছে, তা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগে ডেসটিনি, যুবকের মতো ঘটনা এ দেশে ঘটেছে। এরপরও মানুষ সচেতন হয়নি। কিছু মানুষের আকাশচুম্বী লোভের সুযোগ নিচ্ছে কিছু সুযোগসন্ধানী ধুরন্ধর ব্যবসায়ী। মানুষ নিজের কাজে ঝুঁকি কতটা এ বিষয়ে সচেতন না হলে কোনো সংস্থাই এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে পারবে না।

বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির সমকালকে বলেন, প্রথমত যুবক, ডেসটিনিসহ অন্যান্য প্রতারণামূলক ব্যবসার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠান সুযোগ নিয়েছে। এ ছাড়া ই-কমার্স খাতে নীতিমালা করা হলেও এর স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) করতে দেরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে করোনা একটি কারণ। বর্তমানে যে নির্দেশিকা বা এসওপি করা হয়েছে, এটা আরও আগে করা হলে বর্তমান পরিস্থিতি হতো না। তবে দেরিতে নির্দেশিকা হলেও সামগ্রিক ই-কমার্সের জন্য তা ভালো হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ই-কমার্স দেশে বিকাশমান ব্যবসা পদ্ধতি। এ ব্যবসা বিকাশের সুবিধার্থে 'জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা-২০১৮' করা হয়েছে। সেখানে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কীভাবে ব্যবসা করবে, কোন ধরনের পণ্য ও সেবা বেচাকেনা করতে পারবে, লেনদেন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, বিতরণ ব্যবস্থাসহ সার্বিক বিষয় পরিস্কার করে বলা হয়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতার আচরণ বিধিও ওই নীতিমালায় রয়েছে। নীতিমালার আলোকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনও নিয়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ই-কমার্স ব্যবসার প্রতারণা বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বছর আগে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইভ্যালি ও তার স্বত্বাধিকারীর ব্যাংক হিসাবের তথ্য নেওয়া হয়। একই সঙ্গে দেশের সাতটি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয় ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। এরপর ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়। এ রকম পরিস্থিতি দেখে সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি নির্দেশিকা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা এ বছর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ই-কমার্স যাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়, ক্রেতা, বিক্রেতা ও সরবরাহকারী সব পক্ষের স্বার্থ যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে হাজার হাজার মানুষ ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার অভিযোগ নিয়ে গেছে। সংস্থাটি সব সময় অভিযোগ নিষ্পত্তি করাতেই মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু একই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বারবার মানুষ কেন অভিযোগ নিয়ে আসছে, কোম্পানিটি কেন একই অপরাধ বারবার করছে, সে বিষয়ে মনোযোগ দেয়নি। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে এসব কোম্পানি বিষয়ে অভিযোগও করেনি। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার মতামত পাওয়া যায়নি।

এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব কিছুদিন আগে যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করা বা রিফান্ড না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তাদের কয়েকটির সদস্য পদ বাতিল করেছে। কিন্তু আগে থেকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বা সতর্কতা জারি করেনি। যদিও স্ট্ক্রো সার্ভিসসহ পরিচালন নির্দেশিকা করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়। তাদের লেনদেন আলাদাভাবে মনিটর করারও সুযোগ নেই। কারণ, প্রতিদিন লাখ লাখ লেনদেন হচ্ছে অনলাইনে। ব্যাংকগুলোকে বলা আছে, যে কোনো লেনদেন সন্দেহজনক হলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে। কোনো ব্যাংকই কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লেনদেন সম্পর্কে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য দেয়নি। কিন্তু ইভ্যালির তদন্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখেছে, সেখানে এমন কিছু লেনদেন হয়েছে, যে ক্ষেত্রে ব্যাংকের উচিত ছিল সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট বা এসটিআর করা। কিন্তু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ার পর ব্যাংকগুলো ঠিকই নিজেদের গ্রাহকদের লেনদেন না করার অনুরোধ করেছে।