ই-কমার্সের নামে বিশাল ছাড়ের লোভ দেখিয়ে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা তৎপরতার মধ্যেও তাদের 'ব্যবসা' চলছে। অন্তত চারটি 'ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে' এখনও ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের অফার রয়েছে। এসব অফারে গ্রাহকের জন্য ক্যাশ অন ডেলিভারির (সিওডি) সুযোগ নেই। অগ্রিম টাকা দিয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে। আগের অফারের পণ্যই এখনও গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করতে না পারলেও নতুন নতুন অফার দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রতিষ্ঠান চারটি হলো- আনন্দের বাজার, অল শপার, দালাল প্লাস ও থলে। এ ছাড়া আগেই সন্দেহের তালিকায় ওঠা আলাদীনের প্রদীপ ও সিরাজগঞ্জশপ তৎপরতা চালু রেখেছে। তবে এখন তাদের বড় ধরনের ছাড়ের ঘোষণা নেই।
সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আনন্দের বাজার, অল শপার, দালাল প্লাস, থলে, আলাদীনের প্রদীপ, সিরাজগঞ্জশপ- এ ছয়টি প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে গ্রাহকের কয়েকশ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেরই মালিকপক্ষ লাপাত্তা, অফিস বন্ধ। কিন্তু অনলাইনে তাদের কার্যক্রম চলছে।
আনন্দের বাজার, অল শপার, দালাল প্লাস, থলে মোটরবাইক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। অগ্রিম দাম পরিশোধের পর ২০ থেকে ৪০ কর্মদিবসের মধ্যে পণ্য ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে।
এর আগে একই ধরনের অফার দিয়ে পণ্য সরবরাহ না করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, কিউকম, নিরাপদ, শ্রেষ্ঠ নামের কথিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন সমকালকে বলেন, ক্যাশে পণ্য কেনার সুযোগ না থাকার পাশাপাশি সরকারের ই-কমার্স পলিসি মেনে ১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি নিশ্চিত না করাটা প্রতারণার ফাঁদ ছাড়া কিছুই নয়। এদের এখনই ঠেকানো না গেলে নতুন করে আর্থিক ঝুঁকিতে পড়বেন হাজার হাজার গ্রাহক। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
আনন্দের বাজার গত ২ অক্টোবর থেকে ৭২ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য ছাড় দিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পণ্য বিক্রি করছে। মোটরসাইকেল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যে রয়েছে ৩৫ শতাংশ ছাড়। এ অফারের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি দুই লাখ ৮ হাজার টাকার ইয়ামাহা এফজেডএস ভি৩ মোটরসাইকেল দিচ্ছে মাত্র এক লাখ ৮২ হাজার টাকায়। একই ধরনের অফার রয়েছে সুজুকি, হোন্ডা এবং বাজাজ পালসারের বিভিন্ন মডেলের গাড়িতে। এ অফারের আওতায় পাঁচটি মোটরসাইকেল অর্ডার করলে প্রথম ১০ দিনের মধ্যে একটি মোটরসাইকেল ডেলিভারি দেওয়ার কথা জানাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বাকিগুলো ৩৩ কার্যদিবস পর ডেলিভারি দেবে তারা। আবার কেউ যদি একটি বাইক অর্ডার করে, তবে ১০ দিন পর নয়, ৩৩ কার্যদিবস পর ডেলিভারি দেওয়ার শর্ত দিচ্ছে কোম্পানিটি। একই ধরনের শর্তসাপেক্ষে ৭২ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ে জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডের টিভি, ফ্রিজ, এসি, স্মার্টফোন বিক্রি করছে আনন্দের বাজার।
প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী কয়েক দিন গিয়ে অফিস বন্ধ পাওয়া যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আনন্দের বাজারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এইচ খন্দকার মিঠু আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে মঙ্গলবার রাতে তিনি অজ্ঞাতস্থান থেকে ফেসবুক লাইভে এসে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটি বন্ধের ঘোষণা দেন। গ্রাহকরা ৭০ কোটি টাকারও বেশি পাবেন বলে লাইভে স্বীকার করেন তিনি। এ টাকা ধীরে ধীরে শোধ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
অর্ডারের পণ্য না পেয়ে বন্ধ অফিসের সামনে ভুক্তভোগী ক্রেতা ভিড় করছেন। মাসুদ আলম নামে এক ক্রেতা সমকালকে জানান, গত জুন মাসে দেড় লাখ টাকায় একটা বাইক অর্ডার করেছিলেন। এখন বাইক নয়, অন্তত মূল টাকাটা ফেরত পেলে স্বস্তি পাবেন তিনি।
দালাল প্লাসেরও অফিস বন্ধ। অথচ মোটরবাইক, গাড়ি, স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন পণ্যে ব্যাপক ছাড়ের অফার চলমান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আড়াই লাখ টাকা দামের ইয়ামাহার এফজেডএস মোটরসাইকেল বিক্রি করছে এক লাখ ৬১ হাজার ৮৫০ টাকায়। এছাড়া বাজাজ, টিভিএস, সুজুকি, হোন্ডা, লিফানসহ জনপ্রিয় প্রায় সব ব্র্যান্ডের বাইকে একই রকম ছাড় দিচ্ছে তারা। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটি ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা দামের বাজাজের সিটি ১০০ ইএস মডেলটি ৬৩ হাজার ৩৭৫ টাকায় বিক্রি করছে।
রাজশাহীর অল শপার নামের প্রতিষ্ঠানটিরও অফিস বন্ধ। তারা এখনও ২৫ শতাংশ ছাড় দিয়ে মোটরসাইকেল বিক্রি করছে। এতে করে চার লাখ টাকা দামের ইয়ামাহা এমটি ১৫ মোটরসাইকেলের দাম আসে তিন লাখ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানটিতেও ইয়ামাহা, বাজাজ, হোন্ডা, হিরোর মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল রয়েছে।
চলতি বছরের ২৭ মে টিশার্ট অফারের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে অল শপার। ১২৬ টাকায় টিশার্ট কিনলে ছিল মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, স্মার্টফোনসহ নানা আইটেম বিজয়ের অফার। গত ৪ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে দেখা যায়, এখনও অনেকেই টিশার্ট বুঝে পাননি বলে কোম্পানিটির ফেসবুক পেজে অভিযোগ করে পোস্ট দিচ্ছেন।
থলে নামের প্রতিষ্ঠানটি মোটরসাইকেল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যে ২০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে বাজাজ, সুজুকি, হোন্ডাসহ জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডেরই মোটরবাইকসহ টিভি, ফ্রিজ, স্মার্টফোন রয়েছে।
অল শপার, দালাল প্লাস ও থলের কলসেন্টার নম্বরগুলোতে ফোন দিলেও কেউ রিসিভ করেননি।
আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম খান রানা জানান, বিরাট মূল্যছাড়ের ঘোষণা দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে ব্যবসা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে সিরাজগঞ্জভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান 'সিরাজগঞ্জশপ' ও 'আলাদীনের প্রদীপ'। ফেসবুকে নানা ঘোষণা দিয়ে চলছে তারা। গ্রাহক ও ভেন্ডরদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বেচাকেনা চালু করার জন্য। তবে এখন তারা বড় ধরনের ছাড়ের কথা বলছে না বলে কয়েকজন গ্রাহক ও ভেন্ডর জানিয়েছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সিরাজগঞ্জশপের সবক'টি ইউনিট বন্ধ। স্থানীয় লোকজন জানান, কয়েক সপ্তাহ থেকে এগুলো বন্ধ রয়েছে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জুয়েল রানা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকরাম হোসেন, পরিচালক পারভেজ মাসুদ, আইটি ইনচার্জ আয়তুল আবদুল্লাহ, ব্যবস্থাপক একলাস উদ্দিন প্রান্ত, ব্যবস্থাপক মুনির হোসেন ওরফে কাঁচামাল মুনির, প্রতিষ্ঠানের কো-পার্টনার 'সাইক্লোন বাজার'-এর স্বত্বাধিকারী খান মামুন, হিসাবরক্ষক ইকবাল হোসেন, ম্যানেজার হাসান আলী, সেল-ইনচার্জ হোসাইন আহম্মেদ সা'দসহ দায়িত্বশীল সবাই আত্মগোপনে। অন্যদিকে, 'আলাদীনের প্রদীপ' খোলা রয়েছে। তবে ঢিমেতালে চলছে।
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম সমকালকে বলেন, সিরাজগঞ্জশপ, আলাদীনের প্রদীপসহ আলোচিত এসব ই-কমার্স প্র্রতিষ্ঠানের একমাত্র পুঁজিই হলো 'গ্রাহকের লোভ'। এরই মধ্যে মাসুদ রানাকে দু'বার ডেকে সতর্ক করা হয়েছে।
আলাদীনের প্রদীপডটকম-এর সিইও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মুনের ভাষ্য, 'আমাদের নীতি পঞ্জিনীতি নয়। বিজ্ঞাপন দেখে জেনেশুনে ভেবেচিন্তে কাঙ্ক্ষিত পণ্য পেতে গ্রাহক অর্থ জমা করেন।'
২০ লাখ টাকা নিয়ে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট তারা ব্যবসা শুরু করেন বলে মুন জানান। তিনি বলেন, 'সরকারি চাহিদামতো সব ধরনের নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স আমাদের রয়েছে। গ্রাহককে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২১ কোটি টাকা ডিসকাউন্ট দেওয়া হলেও এটি মূলত তাদেরই অর্থ। সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স অস্থিরতায় গ্রাহকের প্রায় ৫ কোটি টাকার দেনা আমাদের কাছে জমেছে। পেমেন্ট গেটওয়েতে গ্রাহকের কাছে আমাদেরও প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা আটকে আছে।' তিনি দাবি করেন, ১৮ হাজার ইনভয়েসের বিপরীতে গত অক্টোবর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২১ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১২ হাজার ইনভয়েসের বিপরীতে প্রায় ৫ কোটি টাকার মালপত্র সরবরাহ আটকে রয়েছে।
মুন বলেন, 'চলমান অস্থিরতায়ও আমাদের কার্যক্রম থেমে নেই। আগামীতে ২-৩ মাস সময় পেলে হয়তো গ্রাহকের দায়দেনা মুক্ত হওয়া সম্ভব।'
কোটি টাকা মূল্যমানের আসবাব, কম্পিউটার, ৪টি অফিস ও গোডাউন ছাড়া কোম্পানির নিজস্ব তেমন অর্থ নেই বলে জানান মুন।
সিরাজগঞ্জশপ ডটকম-এর সিইও জুয়েল রানাও দাবি করেন, কয়েকজন অংশীদারসহ ২০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন।
মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান 'নগদ'-এর অর্থ লোপাটের অভিযোগ সম্পর্কে জুয়েল বলেন, সাড়ে ৪৭ কোটি টাকার দেনার কথা নগদের পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রচার করা হলেও সেটি মূলত গ্রাহকেরই। নগদ সার্ভার ভুলে গ্রাহককে যদি তারা 'রিকোয়েস্ট পেমেন্ট' দিয়ে থাকে, এটি তাদের ভুলেই হয়েছে। এর দায়দায়িত্ব তাদেরই, কোনোভাবেই গ্রাহক বা আমাদের নয়। ইতোমধ্যে নগদকে আইনজীবীর মাধ্যমে পরিস্কার করাও হয়েছে।'
প্রায় ৬৫ হাজার গ্রাহকের বিপরীতে সিরাজগঞ্জশপের প্রায় ১৭ কোটি টাকার দেনা রয়েছে বলে স্বীকার করেন জুয়েল রানা। তবে তার ভাষ্য, দেনা থাকলেও কোম্পানির ৪৬টি ডেলিভারি যান, একটি প্রাইভেটকার, সদর উপজেলার বহুলী ইউনিয়নের বেড়াবাড়ি ও জেলার তাড়াশের হ্যাচারি এবং মৎস্য ও গরুর খামারসহ আমাদের নিজস্ব প্রায় ৯ কোটি টাকার সম্পদও রয়েছে। প্রায় ৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা টাকা গ্রাহকের পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে রয়েছে। এছাড়া এসএসএল গেটওয়েতে প্রায় ৪৭ লাখ টাকা আছে।
তিনি দাবি করেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে আকাশচুম্বি ছাড়ের প্রলোভন কখনও দেওয়া হয়নি। যদি এমন দেওয়া হতো তাহলে আবারও কার্যক্রম চালুর জন্য আমরা ফেসবুকে প্রচারনা চালাতাম না। পরিবেশ অনুকূলে সময় ও সুযোগ পেলে দেনা পরিশোধ করে ৪-৫ মাসের মধ্যে আবারও আগের দাঁড় করানো সম্ভব।'
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল সমকালকে বলেন, 'অস্বাভাবিক অফার প্রদানকারী বিতর্কিত এসব প্রতিষ্ঠান ই-ক্যাবের সদস্য নয়। তাদের সম্পর্কে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি।'
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ডব্লিউটিও সেল) হাফিজুর রহমান বলেন, ই-কমার্সসংশ্নিষ্ট ব্যবসা করতে হলে নীতিমালা মেনেই করতে হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি সমকালের থেকে অস্বাভাবিক অফার দেওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকা নিয়ে বলেন, আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। কোনো অনিয়ম পেলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, ই-কমার্সের নামে যে বা যারাই প্রতারণামূলক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকুক না কেন প্রমাণসাপেক্ষে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আলোচিত এ প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেলে তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।