- বাংলাদেশ
- দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রুত নগর নীতিমালা চূড়ান্ত করতে হবে
দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রুত নগর নীতিমালা চূড়ান্ত করতে হবে

আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস এবং সিপিপির ৫০ বছর পূর্তি সামনে রেখে রোববার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি ও আলোচকবৃন্দ- সমকাল
হপরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে জাতীয় নগর নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এরপর ২০১৪ সালে এ নীতিমালার খসড়া তৈরি হলেও এখনও চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলায় পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত নগর নীতিমালা চূড়ান্ত করতে হবে। এ নীতিমালা চূড়ান্ত না হলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ থামানো যাবে না বলে জানিয়েছেন বক্তারা।
গতকাল রোববার 'ডিজাস্টার রিস্ক গভর্ন্যান্স : জাতীয় নগর নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞ-আলোচকরা। আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন দিবস-২০২১ এবং সিপিপির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ ও সমকাল এ বৈঠক করে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন। সঞ্চালনা করেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তা, নগর পরিকল্পনাবিদ, নগর উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, দুর্যোগে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দুর্যোগ সহনীয় টেকসই নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় পরিকল্পিতভাবে কাঠামোগত ও অকাঠামোগত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম আর দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং নতুন নতুন কৌশল কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার দেশকে সারাবিশ্বের কাছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনুকরণীয় মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন বাংলাদেশকে কীভাবে ভূমিকম্প সহনীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়, তা নিয়ে কাজ হচ্ছে। এ নিয়ে জাইকার সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। যে বিল্ডিংগুলো বহুতল হয়ে গেছে, সেগুলোকে না ভেঙেই এখন ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতিও হবে না।
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, জলাবদ্ধতা ও ডেঙ্গু মশা নিয়ে কথা হচ্ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনগুলো এরই মধ্যে খালগুলো উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। সেনাবাহিনী এ কাজে সহায়তা করবে। উদ্ধারকাজ ঠিকভাবে করা গেলে দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও বেশি ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। এ জন্য সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিমুক্ত নগর গড়তে জাতীয় নগর নীতিমালা প্রয়োজন। এ জন্য অথরিটিও লাগবে। আইন বাস্তবায়নের জন্য সমন্বয়ও দরকার। যার যে দায়িত্ব, সেটা পালন করা হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে যত শুধু সুন্দর পরিকল্পনাই হোক না কেন, গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারব না। দেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সামনে আরও পরিবর্তন হবে। এ জন্য স্বপ্ন থাকতে হবে। মূল কথা হলো, দেশের জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন বলেন, বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ এখন শহরের সুবিধা পাচ্ছে। গ্রাম থেকে মানুষ শহরে আসবে না। বরং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী গ্রামেই শহরের সুবিধা পাবে। নগরায়ণের দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে দুর্যোগের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ চালু হবে। তখন কোনো স্থাপনা তৈরির আগে জানতে হবে, সেখানে দুর্যোগের ঝুঁকি আছে কিনা।
জাতীয় নগর নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা জরুরি-এ কথা জানিয়ে বৈঠকের শুরুতেই সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, রাজধানীসহ এ দেশের নগরগুলোয় আমাদের নানা দুর্যোগের মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হচ্ছে। একটি নীতিমালা থাকলে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা সহজ হয়। ২০১৪ সাল থেকে এই নীতিমালার খসড়া পড়ে আছে। অথচ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আশা করি, আর ফেলে না রেখে এই নীতিমালা চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ডিজাস্টারের যে ঝুঁকি আছে, বাংলাদেশ তার বাইরে না। এই রিস্ক প্রশমনে সেন্ডাই ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। এর সাতটি গ্লোবাল টার্গেট আছে। সামনের দিনগুলোর জন্য আমাদের ন্যাশনাল ফিজিক্যাল প্ল্যান প্রস্তুত করতে হবে। কনস্ট্রাকশন সেফটির জন্য আমাদের ভবন তৈরি ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা মনিটরিং করার প্রয়োজন আছে। এই ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হলে ডিজাস্টার রিস্ক তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, পরিকল্পিত নগরের জন্য যে ধরনের পরিকল্পনা প্রয়োজন, সেটি আমাদের করতে হবে। আমাদের বিশুদ্ধ পানির জন্য ধীরে ধীরে অনেক বেশি ভূগর্ভে যেতে হচ্ছে। আগে যেখানে কয়েকশ ফুট নিচে গেলেই পানি পাওয়া যেত, এখন সেখানে পানি পেতে ১২৫০ ফুট নিচে যেতে হচ্ছে।
ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মোহাম্মদ আকমল শরীফ বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ নিজেকে অনুকরণীয় মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দিন দিন শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শহরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক কষ্টে জীবন যাপন করছে। নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্যও উদ্যোগ নিতে হবে।
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক ড. খুরশীদ জাবিন হোসেন তৌফিক বলেন, আমাদের দেশটা বিশাল। হেন দুর্যোগ নেই, যেটা আমাদের দেশে ঘটে না। এখানে পরিকল্পনার জন্য কোনো আইনি কাঠামোও নেই। আগে একটা ফটোগ্রাফিক সার্ভে করা হতো। এখন ড্রোন দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কার্যক্রমের পুরোটাই এখন ডিজিটাল।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী ও আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল লতিফ হেলালী বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উদাহরণ আছে। আমাদের প্রকল্পের অধীনে বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা মোট তিন হাজার ২৫২টি ভবন পরিদর্শন করেছে। এখন পর্যন্ত ২২০টা ভবনের ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। একটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কিনা, তা জানতে হলে ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজগুলো করতে হয়।
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. আশরাফুল আলম বলেন, ভবিষ্যতে এখানে যে ভবনগুলো তৈরি হবে, সেগুলো বিএনপিসি অনুসারে হলে কোনো সমস্যা হবে না। তবে আমাদের গবেষণার জন্য বরাদ্দ অনেক কম। যদি আর্থিক সহায়তা করা হয়, তাহলে গবেষণা আরও ভালোভাবে এগিয়ে নেওয়া যাবে।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহম্মেদ খান বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য রাজউকসহ সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে। সংশ্নিষ্ট আইনগুলো আরও সহজ করতে হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আমরা অনেক কিছুর প্রস্তুতি নিয়েছি; কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারছি না। মনিটরিংও করতে পারছি না। জাতীয় নগর নীতিমালা চূড়ান্ত না হলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ থামানো যাবে না।
সিপিপির পরিচালক (প্রশাসন) আহমাদুল হক বলেন, বৈঠকে অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি এবং মানুষ নিয়ে কথা হয়েছে। সিপিপি মানুষকে সতর্ক করার জন্য উপকূলে কাজ করে।
ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আশেকুর রহমান বলেন, ২০০৭ সালে জাতীয় নগর নীতিমালার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর এটা অল্প সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত করার কথা বলেছিল সরকার। এরপর ২০১৪ সালে খসড়া হলেও এখনও সেটি চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, নগরায়ণ নীতিমালার বেশিরভাগ সপ্তম পঞ্চবার্ষিকীর পরিকল্পনায় যুক্ত করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও অনেক নীতি যুক্ত করা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশে এমন একটি এক্সক্লুসিভ নীতিমালার প্রয়োজন নেই। এজন্য আরও অনেক বহুমাত্রিক উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক শামীমা প্রধান বলেন, আরবান ডিজাস্টার নিয়ে অন্য বক্তারা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, তার বাইরেও কিছু কিছু বিষয় আছে। আমাদের এই নগরজীবনে এখন ডেঙ্গু বা এরকম রোগগুলো প্রতিনিয়ত ভোগাবে। এরকম সব বিপর্যয় নিয়েও ভাবতে হবে।
মন্তব্য করুন