![সৈয়দ আবুল মকসুদ [২৩ অক্টোবর ১৯৪৬-২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১]](https://samakal.com/uploads/2021/10/online/photos/Untitled-22-samakal-6171c34435921.jpg)
সৈয়দ আবুল মকসুদ [২৩ অক্টোবর ১৯৪৬-২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১]
সৈয়দ আবুল মকসুদ নামটার সঙ্গে আমার পরিচয় বলা যায় আমাদের ছাত্রজীবনেই। তার লেখার সঙ্গেও তখনই কিংবা তার কিছু পরপর পরিচয় ঘটে। পত্রিকায় প্রকাশের সময়ই বোধহয় তার জার্মানির জার্নাল-এর কতকাংশ পড়েছিলাম। পরে বিশেষ করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসকে নিয়ে তার গবেষণাধর্মী কাজ দুটো তার ব্যাপারে আমার মধ্যে ঔৎসুক্য সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে গোবিন্দ দাসকে নিয়ে তার গ্রন্থ রচনার বিষয়টি বাড়তি আগ্রহ ও সল্ফ্ভ্রমের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আরও পরে মওলানা ভাসানীকে নিয়ে লেখা তার বইটি আমার নিজের কাজে লেগেছে। সংবাদপত্রের কলামধর্মী রচনাগুলোর কথা বাদ দিলে, এ শেষোক্ত বইটি দিয়েই মনে হয় বেশিরভাগ পাঠক আজও সৈয়দ আবুল মকসুদকে চেনেন। যদিও এই বইটি নিয়ে আমার খানিকটা অসন্তুষ্টি বা আসলে অতৃপ্তি ছিল, আর তার সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টির পর একাধিকবার তাকে আমি অকপটেই আমার এই অনুভূতির কথা জানিয়েছি। তিনি আমার সঙ্গে একমত হয়ে মওলানা ভাসানীর একটি প্রামাণ্য ও অধিক সুসংবদ্ধ জীবনীগ্রন্থ রচনার ব্যাপারে তার কাজের অগ্রগতির কথা বলতেন। অনুরূপভাবে নজরুলেরও একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনার ব্যাপারে তার আগ্রহ ও প্রস্তুতির কথা তিনি আমাকে (এবং নিশ্চয় আরও অনেককে) বলেছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয়ের সুযোগ অবশ্য বেশ দেরিতেই হয়। সেও নিতান্ত কর্মসূত্রে। অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পর আমি তখন দৈনিক প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশনার পরামর্শক হিসেবে যোগ দিয়েছি। গোড়ার দিকেই রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ও দর্শনচিন্তা বিষয়ে তার একটি পাণ্ডুলিপি প্রথমে রিভিউ ও পরে সম্পাদনার জন্য আমাকে দেওয়া হয়। পাণ্ডুলিপিটি দেখে আমি যেসব লিখিত পর্যালোচনা ও পরামর্শ প্রদান করি, যৌক্তিক বিবেচনায় তার সবক'টিই তিনি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালেও প্রথমা থেকে প্রকাশিত তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, নবাব সলিমুল্লাহ ও তার কাল সম্পাদনার দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেখকের অকুণ্ঠ সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যা মুগ্ধ করেছে তা হলো, এ বইগুলোর সবক'টিতেই তিনি কখনও 'অনুজপ্রতিম সুহৃদ' আবার কখনও 'অনুজপ্রতিম সাহিত্যিক' হিসেবে আমার নামোল্লেখ করে পরামর্শ বা মতামতের জন্য আমাকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। একে স্রেফ সৌজন্যবোধ বা ভদ্রতা, কী বলব জানি না, তবে আমাদের অনেক বিশিষ্ট বা উচ্চ পদাধিকারী (সাবেক কিংবা বর্তমান) ব্যক্তিকে দেখেছি এ ব্যাপারে এক ধরনের সংকীর্ণতা বা হীনম্মন্যতার পরিচয় দিতে। বইয়ের ভূমিকায় অনেকের নামোল্লেখ করে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও, যিনি তার বইটি আগাগোড়া পাঠ, সংস্কার এমনকি পুনর্লিখন করেছেন, তার নামটিই, মনে হয় যেন সচেতনভাবেই. এড়িয়ে যান। হয়তো একে তারা তাদের জন্য লজ্জার বা অগৌরবের বিষয় বলে মনে করেন (তার মতো বিজ্ঞজনের লেখায় অন্য কেউ হাত চালিয়েছে বা তাকে পরামর্শ দিয়েছে, এটা কী করে হয়!) এই একটি ব্যাপারই আমাদের বিদ্যা বা মননচর্চার পরিমণ্ডলে মানুষ হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদের স্বাতন্ত্র্যকে চিনিয়ে দেয়। নিশ্চয় তিনিই একমাত্র নন, তবে বিশিষ্টদের একজন।
মানুষকে কাছে টানার একটা সহজাত ক্ষমতা মকসুদ ভাইয়ের ছিল। খুব সম্ভব তার সে গুণের কারণেই, আমার স্বভাব আড়ষ্টতা সত্ত্বেও, অল্পদিনেই আমি তার ঘনিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হই। কোনো সভা-অনুষ্ঠানে গেলে অনেক সময় তিনিও ডাকতেন, আবার আমিও নিজে থেকে তার পাশে গিয়ে বসতাম। দেখা হলে চলমান রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাসচর্চা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের মধ্যে কমবেশি আলোচনা বা মতবিনিময় হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো আমাদের মতের মিল হতো, কিন্তু যেখানে তা হতো না সেখানেও ভিন্নমতকে সহজ সচ্ছন্দে গ্রহণ করবার মানসিক সামর্থ্য তার ছিল। অন্যরাও মনে হয় তাদের অভিজ্ঞতা থেকে একই রকম সাক্ষ্য দেবেন।
সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লেখা, বিভিন্ন সভা-সেমিনার-গোলটেবিল, টিভি টক শো, মানববন্ধন কর্মসূচি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ তথা সামাজিক-নাগরিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি, কিংবা বলা যায় সেসব ব্যস্ততার ফাঁকেও, মৃত্যুর আগে কেবল গত কয়েক বছরেই তিনি যেসব গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন, তা রীতিমতো বিস্ময় জাগায়। কী বিষয় নির্বাচন, কী মানের দিক থেকে তার সঙ্গে তুলনীয় কাজ আমাদের একাডেমিক পরিমণ্ডলেও সমসময়ে বেশি হয়েছে বলে মনে হয় না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার তিনটি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব তো শুধু দেশের প্রথম বা সর্বপ্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী ভূমিকার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। আর সেই বোধ থেকেই সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং পরে আলাদাভাবে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের [প্রতিষ্ঠার পটভূমি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠাপর্ব ও পরবর্তী এক যুগের] ইতিহাস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগের জীবনী লিখতে উদ্বুদ্ধ হন [প্রথমে অবশ্য তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ইতিহাস লিখে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লিখতে চেয়েছিলেন]।
অন্য দুটি কাজকে যদি তার মূল গবেষণার উপজাত হিসেবে গণ্য করি, তাহলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস রচনার কাজটি বলাই বাহুল্য তার জন্য খুব সহজ ছিল না। উপরন্তু যদি মনে রাখি যে, এর জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা বা আর্থিক সহায়তা তিনি পাননি। বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কেউ তাকে এজন্য কোনো বৃত্তি বা ফেলোশিপ দেয়নি। সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ও প্রায় একক প্রচেষ্টায় তাকে কাজটি করতে হয়েছে। এর জন্য বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে নানাজনের সঙ্গে তাকে কথা বলতে ও তাদের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও নানা প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার ও সংশ্নিষ্ট অনেকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে চিঠিপত্র, দিনপঞ্জি, দলিল, নথি ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হয়েছে। এভাবে বলা যায় একেবারে প্রাথমিক সূত্রের ওপর নির্ভর করেই একটি মৌলিক গবেষণামূলক কাজ তিনি করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের লগ্নে এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত তার প্রতি আনুষ্ঠানিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তিনি বেঁচে থাকলে, আজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সে সম্মান বা স্বীকৃতি দিত কিনা জানি না, তবে অধ্যাপক এম এ রহিমের লেখা The History of the University of Dhaka (১৯৮১)-এর পর এতগুলো বছরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একটি প্রামাণ্য ইতিহাস রচনা কিংবা প্রতিষ্ঠানটির বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক অবদান নিয়ে যথার্থ তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা না হওয়ার লজ্জা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে মনে হয় আগামীতেও বহন করতে হবে। তবে জাতিকে এই লজ্জা থেকে খানিকটা হলেও উদ্ধার করে গেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ পরপর তার উল্লিখিত তিনটি গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। এজন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে প্রায়শ 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' কথাটি উচ্চারিত হয়। একসময় মনে করতাম আরও অনেক ক্ষেত্রের মতো এই তুলনাটির পেছনেও বাঙালির স্বভাবসুলভ অতিশয়োক্তি কাজ করে। ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশের অধঃগতির কথা বলতে গিয়েও আমরা পরিহাসছলে এই 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' কথাটি ব্যবহার করি। সৈয়দ আবুল মকসুদের বই পড়ার আগে আমরা কজন জানতাম যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় সরকার এবং যারা এর প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা একে সত্যি সত্যি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন?
নানা উৎস থেকে বহু বছর ধরে ও মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে তথ্য ও উপকরণ সংগ্রহ করার ফলে বইগুলো লেখার সময় তাকে কিছু সমস্যা বা অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। সংগৃহীত দলিলপত্র ও হাতে লেখা নোটসের কিছু ইতোমধ্যে স্থানচ্যুত হওয়ায় এবং আমাদের দেশে গ্রন্থাগার বা মোহাফেজখানা সুবিধার অভাবে হয়তো যথাযথভাবে সূত্র উল্লেখ ছাড়া কিংবা প্রায় স্মৃতির ওপর নির্ভর করেও তাকে কখনও কিছু কথা বলতে বা লিখতে হয়েছে। একাডেমিক গবেষণার রীতি অনুযায়ী এই ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতাগুলো একেবারে অস্বীকারযোগ্য নয়। কিন্তু এই সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতিকে বড় করে তুলে ধরে যদি কেউ তার মহৎ ও মৌলিক কাজকে ঊনমূল্য প্রমাণের চেষ্টা করেন, তবে তার বা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা নিয়ে আমরা অবশ্যই সন্দেহ করব। আমাদের বিদ্যায়তনিক পণ্ডিতদের অনুরূপ দুরভিসন্ধিপ্রসূত প্রচেষ্টার কিছু পরিচয় সৈয়দ আবুল মকসুদ তার জীবিতকালেই পেয়ে গেছেন। এ নিয়ে তার ক্ষোভ বা মনোকষ্টের কথাও আমি জানি।
একাডেমিক গবেষণার নামে, শুধু চাকরি ও পদোন্নতির শর্ত পূরণ করতে, বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যেসব ভূরি ভূরি প্রবন্ধ ও অভিসন্দর্ভ উৎপাদিত হচ্ছে তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান-মর্যাদাকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছে সে সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। আর এ নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রন্থের ভূমিকায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও দেশের উচ্চশিক্ষার পরিবেশ বা বাস্তবতা সম্পর্কে মোক্ষম কথাটি বলে গেছেন এভাবে : আজ বাংলাদেশ ভরে গেছে 'বিশ্ববিদ্যালয়ে'- সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিযোগিতা দিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। অবকাঠামো নেই, শিক্ষক নেই, তবু চলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। এ যে কত বড় আত্মঘাতী প্রবণতা, তা উপলব্ধি করার শক্তিও আজ জাতি হারিয়ে ফেলেছে। কারও কয়েক কামরার একটি বাড়ি থাকলেই একটি 'বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। 'বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা আজ একটি আয়ের উৎস, অন্য যে কোনো একটি ব্যবসার মতো। পার্থক্য হলো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠায় প্রচুর পুঁজির প্রয়োজন, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পুঁজি লাগে অল্পই। যেটুকু প্রয়োজন তা পাওয়া যায় শিক্ষার্থীদের থেকেই।
জানি না, সৈয়দ আবুল মকসুদের এই স্পষ্টোক্তিই আমাদের তথাকথিত বিদ্যায়তনিক পণ্ডিতদের কাউকে কাউকে তার রচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছিদ্রান্বেষণে প্ররোচিত করেছে কিনা।
আমাদের ব্যাপক শিক্ষিতজনের কাছেও নবাব সলিমুল্লাহর পরিচয় এখন পর্যন্ত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা তার এই দুটি অবদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার ভক্ত বা অনুরাগী যারা ইতিপূর্বে তার সাধারণ জীবনী বা তাকে নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন তারাও বিশেষ করে বাঙলার মুসলমানদের জাগরণ বা আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার নেতৃত্বদানকারী ভূমিকাটিকেই প্রধান বা একমাত্র গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ঢাকা তথা পূর্ব বাঙলার মানুষের কল্যাণে তার বিভিন্নমুখী অবদান, এতদঞ্চলে জ্ঞান, বিদ্যা ও সংস্কৃতিচর্চায় তার উদার পৃষ্ঠপোষকতার কথা আমরা কজন জানি? তেমন বিশদভাবে জানার উপায়ই-বা কী ছিল? ভবিষ্যতের বাংলাভাষী পাঠকের জন্য সে জানার কাজটিকে সম্ভব করে তুলেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ নবাব সলিমুল্লাহ ও তার সময় বইটি রচনার মাধ্যমে। এ কাজটিকেও তিনি তার জীবনের একটা বড় দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন। একাডেমিক দিক থেকে বিচার করলে বা গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে এ বইটিরও কিছু ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা হয়তো আছে। যেমন একই তথ্যের পুনরাবৃত্তির বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি হয়তো মজা করেই বলেছিলেন, ইচ্ছা করেই তিনি সেটা করেছেন, যাতে কেউ চাইলেও 'মিস' করতে পারে। সৈয়দ আবুল মকসুদের এই বইটির প্রকাশ আমাদের মধ্যে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য নবাব সলিমুল্লাহর সে সময়টায় ছিল কিনা এই তর্ক তুলে তার অবদানকে নাকচ করতে চান, কিংবা কোনো এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সলিমুল্লাহ বিষয়ে একটি খুচরো মন্তব্য ['লোকটা তো ঘোরতর সাম্প্রদায়িক ছিল'] বা ওই জাতীয় কিছু অগভীর পাঠের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সাধারণত কথা বলেন, তাদেরকে অন্তত একটি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে বলে আশা করি।
জীবনের শেষ সতেরো কি আঠারো বছর তার সেলাইবিহীন শুভ্রবসন দেশবাসী অনেকের কাছে তাকে বিস্ময় বা ঔৎসুক্যের পাত্র করে রেখেছিল। যারা হয়তো তার লেখালেখি কিংবা বৌদ্ধিক ও সামাজিক অবদান সম্পর্কে সামান্যও ওয়াকিবহাল নয়, এমন লোকজনকেও দেখেছি তার ওই পোশাকের ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করতে। সভা-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েও তাকে কখনও ধৈর্য সহকারে আবার কখনও কিঞ্চিৎ বিরক্তির সঙ্গে এই 'কাফনের কাপড়' পরার কারণ ব্যাখ্যা করতে হতো। শিক্ষিত লোকদেরও অনেকে মনে করতেন যে গান্ধীবাদী হিসেবেই তার এই পরিধেয়। আমি নিজে একবার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তার উল্লেখ করতে গিয়ে বলতে শুনেছি, 'ওই যে আপনাদের একজন লোক আছেন না যিনি বিদ্যাসাগরের মতো কাপড় পরে ঘুরে বেড়ান!' সৈয়দ আবুল মকসুদ গান্ধীভক্ত ছিলেন। আর সব বাঙালির মতো বিদ্যাসাগরের প্রতিও তার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। ছিলেন ভাসানীর বিশেষ অনুরাগী। তাদের সাদামাটা পোশাক ও সহজ জীবনপ্রণালি নিশ্চয় তাকে আকর্ষণ করত। কিন্তু এর সঙ্গে যে তার ওই বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধানের অন্তত সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না, সেটা অনেকেরই হয়তো জানার সুযোগ হয়নি। এমনকি আমরা যারা এর প্রেক্ষাপটটা জানতাম, তারাও কখনও কখনও তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে একটু-আধটু রসিকতা যে করিনি তা নয়। তিনিও বিষয়টিকে হালকাভাবেই গ্রহণ করতেন। কিন্তু ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের আগ্রাসনের প্রতিবাদে তার পাশ্চাত্য ধরনের পোশাক বর্জনের সিদ্ধান্ত এবং তারপর এতগুলো বছর ধরে ও আমৃত্যু তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা, আমাদের সমাজে একজন একাকী ব্যক্তির এই বিবেকী অবস্থান বা প্রতীকী প্রতিবাদের গুরুত্ব বা তাৎপর্যকে কি আমরা কখনও ঠিক উপলব্ধি করতে পেরেছি? ভবিষ্যতেও কি পারব?
এমনিতে তার সঙ্গে আমার খুব বেশি যে যোগাযোগ হতো তা নয়। দেখা হতো সাধারণত কোনো সভা-অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া আমাদের অফিসে এলে, বসে বা হয়তো দাঁড়িয়েই কিছু কথাবার্তা- চলমান কোনো ঘটনা বা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ হতো। সহকর্মীদের মধ্যে দু-একজন যেমন আখতার হুসেন ও জাফর আহমদ রাশেদ তার রসালো কথাবার্তার বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন, ফলে তার গল্পগুজব বা আড্ডাটা হতো আসলে তাদের সঙ্গেই। সেখান থেকে কিছু রস হয়তো ছিটকে মাঝেমধ্যে দূরে বসা আমার কান অবধি পৌঁছত। কখনও কখনও বিশেষ করে শুক্র বা শনিবার সকালে তিনি আমাকে ফোন করতেন। তার যে পাণ্ডুলিপিটি আমি হয়তো দেখছি বা ইতোমধ্যে দেখে দিয়েছি তা নিয়ে হয়তো অল্পআধটু কথা বলতেন। আমার কোনো সমস্যা বা অসুবিধা হচ্ছে কিনা জনিতে চাইতেন। কখনও আবার চূড়ান্ত সম্পাদনার পরও বই বের হতে দেরি হচ্ছে মনে করে মৃদু অনুযোগ বা সংশ্নিষ্ট কারও সম্পর্কে ক্ষোভও প্রকাশ করতেন। আমিও কখনও হয়তো তার বিশেষ কোনো কলাম পড়ে খুশি হয়ে তাকে ফোন করতাম। তারপর সেই সূত্র ধরে সমাজ-রাজনীতি নিয়ে আমাদের মধ্যে খানিকটা আলাপ হতো।
নিজের লেখালেখির ক্ষতি হচ্ছে বা তার জন্য সময় পাই না বলে আমি প্রায়ই সহকর্মীদের কাছে চুক্তির মেয়াদ শেষে কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতাম। তার কাছেও হয়তো কখনও বলেছি। কিংবা সহকর্মীদের কাছে শুনেও হতে পারে, শেষদিকে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, অফিসে বা বাইরে যেখানেই তার সঙ্গে আমার দেখা হোক, একটা বাক্য তিনি নির্ঘাত বলবেনই, 'আমার সলিমুল্লাহ দেখে না দিয়ে কিন্তু যাওয়া নাই।' এমনকি কপট হুমকিও দিতেন, 'মতিকে [মতিউর রহমান] বলে আটকে দিব।' করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে আমি সম্পূর্ণ গৃহবন্দি, বাসায় বসেই অফিসের কাজ করি। যতদূর জানি নবাব সলিমুল্লাহকে নিয়ে লেখা পাণ্ডুলিপিটা যাতে আমাকেই দেখতে পাঠানো হয় সেজন্য তিনি মতি ভাইকে ফোনে একবার কি দু'বার অনুরোধও করেছিলেন। তো বইটি বেরোবার কদিন পরই তিনি চলে গেলেন।
তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট আমরাও একে অপরের সঙ্গে দেখা হতে প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর বা তার অংশ হিসেবে সাধারণত নিজেদের আধিব্যাধি নিয়ে কথা বলি। কিন্তু তার সঙ্গে প্রায় এক দশকের আলাপে কখনও আমি তাকে কোনো শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য সমস্যার কথা বলতে শুনিনি। অন্য কাউকে বলতেন কিনা জানি না। আমার ধারণায় তিনি খুব স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ ছিলেন। ছিলেন নিরামিষভোজী, পানাহারেও সংযমী। দীর্ঘপথ দ্রুত হাঁটতে পারতেন। ফলে তার হঠাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদে অবাক হয়েছিলাম। আবার করোনাকাল বলে আতঙ্কও জেগেছিল মনে। অসুস্থ হওয়ার দু-একদিন আগে তিনি আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, নবাব সলিমুল্লাহকে নিয়ে লেখা তার বইটি আমি হাতে পেয়েছি কিনা, অফিস আমাকে দেবে কিনা. নাকি তিনিই এক কপি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। বইটি নিয়ে আমার পরিশ্রমের জন্য বারবার আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। আমি মজা করে বললাম, 'এটা তো আমাদের যৌথ প্রযোজনা! আমাদের দিক থেকে এই তাগিদ ও চেষ্টাটা না থাকলে, আপনার যত রকম ব্যস্ততা, তাতে আপনি তো আজও কাজটা শেষ করতে পারতেন না!' 'তাই! তাই!!' বলে তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ফোনের ওপারে মনে হয় একটু হাসলেন। জানতাম না সেটাই হবে তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। অন্যদিন কাজের কথা ছাড়াও তিনি আমার সঙ্গে চলমান রাজনীতি, সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা কিংবা বিশিষ্ট কারও ভূমিকা নিয়ে কমবেশি কথা বলতেন। কিন্তু মনে করে দেখছি, সেদিন সেসব বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।
মন্তব্য করুন