
সৈয়দ আবুল মকসুদ (১৯৪৬-২০২১)
সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন দেশের বরেণ্য লেখক ও গবেষক। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তার পেশাগত জীবন শুরু। এ পেশা তাকে খ্যাতি দিয়েছিল। তবে সাংবাদিকতায় তিনি আটকে থাকেননি। তিনি মননশীল প্রবন্ধ ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল।
সৈয়দ আবুল মকসুদ অতীতে চোখ মেলেছেন। লেখালেখিতে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধনে সচেষ্ট থেকেছেন। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মনীষীদের জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, হরিশ্চন্দ্র মিত্র, ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, নবাব সলিমুল্লাহ ও তার সময় প্রভৃতি সৈয়দ আবুল মকসুদের অনন্য সৃষ্টি। তবে তার বড় কাজ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনগ্রন্থ।
মওলানা ভাসানীকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সৈয়দ আবুল মকসুদের বইয়েই পরিপূর্ণ মওলানাকে পাওয়া যায়। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মওলানা ভাসানীর জীবনের নানা দিক তিনি তুলে ধরেছেন। তার লেখা কাগমারী সম্মেলনেরও কেন্দ্রীয় চরিত্র মওলানা ভাসানী। সম্মেলনে ভারত ও তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী-সাহিত্যিকের যোগদান, নানা বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ, ভাসানীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো অবস্থান বাঙ্ময় হয়ে আছে বইটিতে। আমি মুগ্ধ হয়ে বইটি একাধিকবার পড়েছি- কাগমারী সম্মেলনের ওপর এমন নিখুঁত বর্ণনা আর কোথাও পাইনি।
মওলানা ভাসানীর প্রতি সৈয়দ আবুল মকসুদের শ্রদ্ধা ও কৌতূহল ছিল প্রবল। একখানা ঢাউস গ্রন্থ লেখার পরও মওলানা ভাসানী সম্পর্কে মকসুদ ভাইয়ের কৌতূহল নিবৃত্ত হয় না। একবার তিনি আমার কাছে জানতে চান, মওলানা সম্পর্কে আমি কোনো ঘটনা বা কাহিনি জানি কিনা। আমি দুটি কাহিনি বললাম। তা ছিল দুই ভক্তের কাণ্ড। মকসুদ ভাই ঘটনা দুটি বেশ উপভোগ করলেন। এর সম্ভবত বছরখানিক পর মকসুদ ভাই জানালেন, তার লেখা নতুন বই 'ভাসানী কাহিনী' বেরিয়েছে। এতে আমার বরাত দিয়ে ঘটনা দুটির উল্লেখ করেছেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ একই সঙ্গে গবেষক, মননশীল প্রাবন্ধিক ও জনপ্রিয় কলাম লেখক। গাদা গাদা গদ্য রচনার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে তার কবি-পরিচয়। গদ্য ও পদ্য উভয় রচনায় তিনি অনবদ্য। তার গদ্যেরও ছন্দ আছে; আছে নিজস্ব স্টাইল।
সৈয়দ আবুল মকসুদের জীবনাচারে ছিল নিজস্ব স্টাইল। তিনি অতিমাত্রায় বিনয়ী, একই সঙ্গে প্রতিবাদী। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় চাকরি করতেন, পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখতেন। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে কর্তৃপক্ষ আপত্তি করায় চাকরি ছেড়ে দেন। বুঝিয়ে দেন- পরাধীন নিশ্চিত জীবনের চেয়ে অনিশ্চিত জীবনের স্বাধীনতা বড়। ইরাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ ছিল অভিনব। তিনি পশ্চিমা পোশাক বর্জন করেন। প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে দুই প্রস্থ সাদা কাপড় পরতে শুরু করেন। আমৃত্যু সেটাই ছিল তার পরিধেয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেই দায়িত্ব শেষ করেননি। গণমানুষের আপদে-বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াতেন, প্রতিবাদ করতেন। তিনি ছিলেন বঞ্চিত-নিপীড়িতের বন্ধু, গণমানুষের বুদ্ধিজীবী। অন্যায়-অনাচার-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার কলম ও কণ্ঠ ছিল সদা সোচ্চার। যেখানে অন্যায়-অনিয়ম, সেখানেই ছিল তার সরব উপস্থিতি। কোথায় ছিলেন না তিনি! তাকে দেখা যেত নদী ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে, বাস ভাড়া বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ সমাবেশে, দুর্ঘটনা রোধের মানববন্ধনে, নানা শ্রেণি-পেশার সভা-সেমিনার ও গোলটেবিলে।
এক দিনের ঘটনা বলি। তোপখানা রোডে মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। বললেন, প্রেস ক্লাবের ওই গোলটেবিলে যাবেন না? বললাম, চলেন, যাই। প্রেস ক্লাবের গেটে আসার পর দু'তিনজন লোক মকসুদ ভাইকে সালাম দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। আমি হেঁটে প্রেস ক্লাবে গেলাম। মকসুদ ভাই আর আসেন না। গোলটেবিল শুরুর কিছুক্ষণ পর তিনি সভাস্থলে ঢুকলেন। বললাম, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? বললেন, কোনো একটি সংগঠন মানববন্ধন করছে। ওরা খুব করে ধরল। তাই সংহতি জানিয়ে এলাম। মকসুদ ভাই কাউকে অবিশ্বাস করতে পারতেন না। ভুল আমন্ত্রণ রক্ষা করে কখনও কখনও বিব্রত হয়েছেন। তাই কড়া সুরে বললাম, না জেনে-শুনে, খোঁজ-খবর না নিয়ে যেখানে-সেখানে কেন যে যান! মকসুদ ভাই আমতা আমতা করে বললেন- না, এটি ভুয়া সংগঠন না। ওদের দাবি-দাওয়াও যৌক্তিক। এই হলো সৈয়দ আবুল মকসুদ।
মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমি অনেক সভা-সেমিনার-টকশোতে অংশ নিয়েছি। সবই আজ স্মৃতি। মনে পড়ে ২০০৮ সালের কথা। একুশের বইমেলায় 'রাজনীতির কালাকাল' নামে আমার একটা বই বের হলো। মকসুদ ভাই তখন ইরাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের সোচ্চার প্রতিবাদ জারি রাখায় দেশের আলোচিত ব্যক্তিত্ব। অনুরোধ করলাম মেলা মঞ্চে আমার বইটির মোড়ক উন্মোচনের জন্য। তিনি বললেন, বইটি পাঠিয়ে দিন। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আগের দিন রাতে বইটি পাঠালাম। অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতা শুনে মনো হলো, বইটি আদ্যোপান্ত পড়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে আরও বিস্মিত হতে হলো। ঝরঝরে হস্তাক্ষরে দুই-তিন পৃষ্ঠা লেখা দিয়ে বললেন, সমকাল বা অন্য কোথাও ছাপাতে পারেন। 'রাজনীতির কালাকাল'-এর ওপর রিভিউ। আমার কাছে সেটি ছিল অগ্রজপ্রতিম বন্ধুর আশীর্বাদ।
একবার একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা থেকে মকসুদ ভাই ও আমি ফরিদপুর যাচ্ছিলাম। পাটুরিয়া ফেরিতে ওঠার পর মকসুদ ভাই ফেরির ছাদে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার পাশে- সেদিকে তার খেয়াল নেই। তিনি এক ধ্যানে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর দেখি, তার চোখে জল। বললাম, মকসুদ ভাই, আপনার কী হয়েছে? নদীর দিকে তর্জনী হেলিয়ে বললেন, এই তো আমাদের বাড়ি। আমি বললাম, এখানে তো নদী। 'এক সময় এখানে আমাদের বাড়ি ছিল, যা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে'- বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন মকসুদ ভাই। তিনি শৈশবে ফিরে গেলেন। যতক্ষণ ফেরিতে ছিলাম, ততক্ষণ তার শৈশবের গল্প শুনছিলাম। শুনছিলাম তার জীবন-ভাবনা। মনে হয়েছিল, সাদা পোশাকে ঢাকা সৈয়দ মকসুদের মধ্যে একজন বাউল বসত করে। পোশাকে গান্ধিয়ানা থাকলেও তার ওপর ছিল লালনের প্রভাব। এক দিন ঠাট্টা করে বলেছিলাম, মানিকগঞ্জের চরে আখড়া বানিয়ে ধ্যান করবেন। তা না করে ঢাকা এসে সব ঝামেলা করছেন! তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসেছিলেন।
মকসুদ ভাইকে আবেগপ্রবণ হতে দেখেছিলাম আরেক দিন। উচ্চ আদালতে একটি ফরিয়াদ জানাতে গিয়ে তিনি তিরস্কৃত হলেন। তার বুদ্ধিবৃত্তিক মান নিয়েও অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করা হয়। ওই দিন রাতে আমি এক টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে ছিলাম। সেখানে প্রসঙ্গটি এলো। বললাম, সৈয়দ আবুল মকসুদ অপরাধ করে থাকলে আদালত তাকে শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু তার বুদ্ধিবৃত্তিক মান নিয়ে উপহাস বা অশোভন মন্তব্য করতে পারেন না; এটি বিচারকের এখতিয়ার-বহির্ভূত। টকশো শেষে মকসুদ ভাইয়ের ফোন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, এই কষ্ট-যন্ত্রণার মাঝে আমার স্বস্তি- আপনারা আমার পাশে আছেন।
মকসুদ ভাই ছিলেন বন্ধুবৎসল। তার পরিবারের বাইরেও ছিল বন্ধু ও সুহৃদদের নিয়ে বৃহৎ পরিবার। সেই পরিবারের আমিও একজন। দীর্ঘদিন দেখা না হলে তিনি ফোন করতেন। জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছি, কী লিখছি। আমার লেখা পড়ে ফোন দিয়ে প্রশংসা করতেন। ভিন্নমত থাকলে অকপটে বলতেন। কোনো কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে বিতর্কও হতো। তাতে দূরত্ব বাড়ত না। করোনার মধ্যেও কয়েকবার কথা হয়েছে।
শেষবার ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিরণ শঙ্কর রায়ের বাড়ি মানিকগঞ্জের কোথায়, গ্রামের নাম কী? বললেন, গ্রামের নাম তেওতা। তারা পাশাপাশি গ্রামের লোক। কিরণ শঙ্কর ও তার ভাইদের সঙ্গে মকসুদ ভাইয়ের বাবার বন্ধুত্ব ছিল। আসা-যাওয়া ছিল। শৈশবে মকসুদ ভাই ওই বাড়িতে গিয়েছেন। রায় বাড়িতে বড় লাইব্রেরি ছিল, অনেক বই ছিল। বেশিরভাগ আইনের বই। দেশভাগের পর কিরণ শঙ্কর রায়ের পরিবার যখন দেশ ছাড়ল, তখন তার বাবাকে লাইব্রেরির একাংশ উপহার দেন, যা মকসুদ ভাইয়ের ব্যক্তিগত লাইব্রেরির অংশে পরিণত হয়। বিদায় বেলায় রায়বাবু তার বাবাকে বলেছিলেন, 'একটা ছেলেকে ওকালতি পড়িও।' বললেন, 'আমার বাবার ইচ্ছে ছিল, আমাকে উকিল বানাবেন। রায়বাবুর উপদেশ ও বাবার ইচ্ছা পূরণ হলো না। তবে তার উপহার আমার লেখালেখিতে সহায়ক হয়েছে...।' মকসুদ ভাইয়ের কথা যেন শেষ হয় না। তিনি আরও বললেন, যুক্ত বাংলা উদ্যোগ ও কিরণ শঙ্কর রায়ের ভূমিকা নিয়ে কাজ করবেন। কাজটি শুরু করেছিলেন কিনা, আমার জানা নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদের হাতে অনেক কাজ ছিল, অনেক কিছু করার পরিকল্পনা ছিল। তা করার মতো শরীর-স্বাস্থ্যও ছিল। নিয়মনিষ্ঠ মানুষটির আরও পাঁচ, দশ, বিশ বছর চরে বেড়ানো অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তা হলো না। অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে গেলেন। তবে যা রেখে গেলেন তা অসামান্য; ৪০টি গুরুত্বপূর্ণ বই, পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা অনেক নিবন্ধ, অনলাইন-টেলিভিশন-ইউটিউবে ধারণকৃত অসংখ্য সাহসী উচ্চারণ।
সৈয়দ আবুল মকসুদের আজ ৭৬তম জন্মদিন। এটি ভয়ানক কষ্টকর- তিনি আমাদের মাঝে নেই! তবে বিশাল সৃষ্টির মাঝেই সৈয়দ আবুল মকসুদ বেঁচে থাকবেন, স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যখন পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নোয়াখালীতে গান্ধী, মওলানা ভাসানীর সংগ্রামী জীবন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্য জীবন, আরও অনেক বিষয় আলোচিত হবে, তখন সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রসঙ্গ আসবে। বারবার উচ্চারিত হবে তার গ্রন্থগুলোর নাম।
লেখক ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন