মস্ত বড় উঠোনটার এক প্রান্তে সারি সারি মানকচু ও দুধ মানকচুর গাছ। শ্রাবণ মাস তো! এই কচু গাছগুলোর ওপাশে মাথা তুলেছে গুঁড়িকচু-শটিসহ অন্যান্য আগাছা। তারপর থেকেই ঝোপঝাড়ের অবাধ বিস্তার। ওখান থেকেই শুরু বিশাল গ্রামীণ বনটার। বড় বড় নানান রকম বৃক্ষ যেমন আছে, তেমনি আছে মাঝারি ও ছোট ছোট গাছ, তাল-নারকেল-সুপারি গাছসহ আরও কত গাছসহ দুর্গম ঝোপঝাড় ও ডোবানালা। বাগানটার চাঁদোয়া ভেদ করে সূর্যের আলো কোনো ঋতুতেই মাটিতে পড়তে পারে না।

সকালবেলায় উঠোনের মাঝখানে বসে কয়েকজন ছেলেমেয়ে পাথরের সাদা মার্বেল দিয়ে খেলছে। উঠোনের বাগান লাগোয়া প্রান্তে চরছে বাড়ির মুরগিগুলো। উঠোনে ছিটানো ভাত-চালের খুঁদ খাওয়া নিয়ে ওরা খুনসুটিতে মেতেছে। একটি বিড়াল-মাতা বরই গাছটার তলায় ছানা তিনটির সঙ্গে মজার খেলায় মেতেছে। হঠাৎই বিড়াল-মাতা তাকাল মানকচুর ঝাড়গুলোর দিকে, চোখে ফুটল ভয়, থাবা দিয়ে ছানা তিনটিকে উল্টে ফেলে দিয়ে নিজে দৌড়ে গোলাঘরের মাচানে চড়ে বসল। অবুঝ ছানা তিনটি অবাক- কেন মা খেলা ফেলে তাদের থাবা মেরে দৌড়ে চলে গেল! এ সময়ে উঠোনের ওই মানকচুর একটা ঝাড়ের পাশের মাঝবয়সী একটা মুরগির ওপরে দুঃস্বপ্নের মতো লাফিয়ে পড়ল একটা মস্ত বড় (সাধারণত এত বড় বনবিড়াল চোখে পড়ে না সহজে) বনবিড়াল, মুরগিটিকে সামনের ডান থাবার নিচে চেপে ধরল কষে- ওই চাপেই মুরগির প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার কথা, মুরগির আর্তচিৎকার ও ডানা ঝাপটানির শব্দে মার্বেল খেলারত ছেলেমেয়েরা তাকিয়েই যখন দেখতে পেল ভয়ানক কাণ্ডটা, ভয়ে দৌড়ে গিয়ে ঘরের বারান্দায় উঠে চিৎকার শুরু করল, কিন্তু বনবিড়ালটি কয়েক সেকেন্ডের ভেতর থাবার নিচে চেপে ধরা মুরগিটিকে পিঁড়িতে বেলুন দিয়ে রুটি বানানোর কৌশলে বেলল, মুরগিটি নিথর- ওই নিথর মুরগিটিকে মুখে ধরে বনবিড়াল কয়েকটি অদৃশ্য হয়ে গেল বাগানের ভেতর। ছেলেমেয়েগুলো যেন দেখল আশ্চর্য ভেলকিবাজি! রান্নাঘর থেকে মা ও প্রতিবেশীরা দৌড়ে এলেন, ছেলেমেয়েরা ভয়ে চোখ বড় বড় করে বলল- বনবিড়াল না, মেছোবাঘ ওটা! না হলে আমরাই তো ধাওয়া দিতাম। তবে, মুরব্বিরা বললেন, এই বনবিড়ালটার বাচ্চা আছে। আশপাশের অনেক বাড়িতেই হামলা করে হাঁস-মুরগি ও ছানাপোনা তুলে নিচ্ছে। আবারও আসবে। একজোড়া বাঘা কুকুর আছে। এই বাড়িসহ আশপাশের ৭-৮টি বাড়িজুড়েই ওদের অবাধ চলাচল। ঘটনার মুহূর্তে যদি ওরা এ বাড়িতে থাকত, তাহলে হাঁকডাক করে ধাওয়া দিত, বনবিড়ালটিকে শিকার ফেলে হয় পালাতে হতো, না হয় গাছে চড়ে বসতে হতো। তবে, কোনো কোনো বনবিড়াল এ রকম ক্ষেত্রে মুখের শিকার ফেলে উল্টে রুখে দাঁড়ায়, পেছনের দু'পায়ের ওপর খাড়া হয়ে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভেতরে এক বা একাধিক কুকুরের নাকে-মুখে ও চোখে ভয়ানক খামচি মারে- ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বেকুব কুকুর আর এগোয় না। শিকার মুখেই লম্বা লম্বা লাফে পালায় বনবিড়ালটি। আজকের ঘটনায় দেখা গেল পোষা বিড়ালটি ভয় পেয়েছিল বনবিড়ালটিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসতে দেখে, ছানাদের ওটা সতর্কও করেছিল, কিন্তু ছানারা বোঝেনি মায়ের ভাষাটা। যখন বুঝেছে বনবিড়ালটিকে দেখে, তখন ভয়ে চড়ে বসেছে বরই গাছটিতে। বনবিড়ালের সামনে পোষা বিড়াল পড়লে (বাড়ির আঙিনা বা মাঠ-বাগানে) কামড়ে-আঁচড়ে একেবারে দফারফা করে। বিড়ালছানা পেলে প্রবল আক্রোশে কামড়ে মেরে ফেলে। এই বাড়ির মার্বেল খেলারত ছেলেমেয়েরা যদি এটাকে মেছোবাঘ না ভেবে বনবিড়ালই ভাবত, তাহলে ভয় পেত না- হাঁকডাক করে কুকুর ডাকত, ধাওয়া করত। কুকুর বা মানুষের তাড়া খেলে আত্মরক্ষার জন্য বনবিড়ালরা প্রথমত যে সহজ কাজটি করে, সেটা তাদের জন্য হয় ভয়ংকর আত্মঘাতী! তাড়া খেলে কে আর কষ্ট করে দৌড়ায় শুধু শুধু! লাফ দিয়ে গাছে চড়ে বসে। কুকুররা ওপরমুখো হয়ে প্রচণ্ড হাঁকডাক ছেড়ে যেন বলতে চায়- সাহস থাকলে নেমে আয় ব্যাটা! তোর মুণ্ডু চিবাবো! বনবিড়ালটা নিচের দিকে তাকিয়ে যেন গোঁফের তলায় চিকন হাসি ফুটিয়ে বলে- কচু করবি ব্যাটারা আমার! আমার একটা গোঁফও খসাতে পারবি না!

তবে, বিপদ ঘটে তখন- যখন মানুষের নজরে পড়ে। হাঁস-মুরগি ও ছাগলছানা খোয়ানো ক্ষুব্ধ মানুষ ও শিশু-কিশোররা লাঠিসোটা হাতে গাছে চড়ে- আশপাশের নারকেল-সুপারি গাছে চড়ে। হাতে থাকে লম্বা লম্বা লাঠি, বনবিড়াল ভয়ে মগডালে উঠেও লাঠির গুঁতো-খোঁচা থেকে রেহায় পায় না। তবুও নামতে বা লাফ দিয়ে তলায় পড়তে ভয় পায়। একটি পোষা বিড়াল বা বনবিড়াল অথবা মেছোবাঘ যদি ১৫-৪০ ফুট ওপর থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে জেনেবুঝে ও দেখে-শুনে, তাহলে হয় না তেমন কিছুই, এই না হওয়ার পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু লাঠির খোঁচা খেয়েও বনবিড়াল গাছ থেকে নামতে বা লাফ দিতে তখনই ভয় পায়- যখন গাছতলায় হয়তো আছে একাধিক কুকুর, লাঠিসোটা হাতে মানুষজন। লাফ দিলেই তো খতম। তবে, শুধু লাঠিসোটা হাতে মানুষকে ওরা থোড়াই কেয়ার করে। দু'চারটা লাঠির আঘাত ওদের কাবু করতে পারে না, মাথায় লাগলে ঘুরে কাত হয়ে পড়ে যায়। পিঠে লাঠি মারলে মনে হবে- ফুটবলের ওপর লাঠি পড়ে উল্টে আসছে লাঠিখানা। কুকুর থাকলে লাফ দিতে ভয় এই জন্য পায় যে, উঁচু থেকে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে মুভ করা বা দৌড় দেওয়া যায় না, টাল সামলে নেওয়ার আগেই কুকুরের কবলে পড়তে হয়। কুকুর বা মানুষের কবলে পড়ে একটি মা-বনবিড়ালের মৃত্যু মানে- দুধ পান করা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ৪-৫টি ছানারও মৃত্যু। অবশ্য, খোলামাঠ বা বাগানে দেশি জাতের ৪-৫টি কুকুরও জোরসে তাড়া করে বনবিড়ালের লেজের একটি পশমও খসাতে পারে না। কারণ, বনবিড়ালরা তো দৌড়ায় না, লাফায়- যে লাফের দূরত্ব প্রয়োজনে ৮-১৪ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। জীবনবাজি দৌড় বা লাফের ওপরে কি আর কিছু থাকতে পারে!

আমাদের বাল্য-কৈশোর ও তরুণবেলায়- এমনকি ২০০০ সাল পর্যন্ত আমার গ্রামসহ পুরো বাগেরহাট জেলা ও খুলনার রূপসা উপজেলার গ্রামীণ বনগুলোতে বনবিড়াল ছিল অনেক। ছানা দেওয়ার পরে মা-বনবিড়াল ছানাদের পুষ্টিকর খাবার খাইয়ে তাড়াতাড়ি বড় করার জন্য গেরস্থবাড়ির হাঁস-মুরগি তথা ছানাদের দিকে হাত বাড়াত ডাকাতের মতো। চতুর, অসম্ভব বুদ্ধিমান ও তুখোড় শিকারি বনবিড়ালের প্রধান অস্ত্র হলো তার সামনের দুখানা থাবা। দিনদুপুরে- এমনকি মানুষজনের ভেতর থেকেও দুঃসাহসিকতায় হাঁস-মুরগির ছানা তুলে নিয়ে যায় চরম কুশলতায়। এমনকি আহত হাঁস-মুরগির লোভে- যেটা হয়তো সে খানিক আগে শিকার করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে, আহত হয়েছে শুধু, সেটার লোভে বার বার চক্কর দেয়। গাছে চড়তে ওস্তাদ, লম্ম্ফবিদ, দক্ষ সাঁতারু। বনবিড়ালের ছানা এনে আজও গ্রামবাংলায় পোষেন অনেকে। ফিডারে দুধ পান করে। একটু বড় হলে পোষা বিড়ালের মতো ভাত-মাছের কাঁটা খায়। কিন্তু শরীরে যখন আসে যৌবনের ভরা জোয়ার, তখন বেরিয়ে পড়ে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর খোঁজে। এভাবে এক সময় হারিয়ে যায় জঙ্গলেই। আমি ও আমরাও প্রায় প্রতি বছরই ছানা পুষতাম কত সোহাগ-আদরে, সময়ে ঠিকই চলে যেত! হারিয়ে যেত।

সারা বাংলাদেশে আজও দেখতে পাওয়া বনবিড়ালের ইংরেজি নাম Jungle Cat। বৈজ্ঞানিক নাম Felis chaus। মূল শরীরের দৈর্ঘ ৫০-৯৪ সেন্টিমিটার, শুধু লেজটি ২০-৩১ সেন্টিমিটার। ওজন ০৪-০৯ কেজি, উচ্চতা ৩৬-৪০ সেন্টিমিটার। বয়সভেদে ওজন বেশি-কম হয়। কমবেশি বেঁচে থাকে ১০-১২ বছর। লেখার শুরুতে যে বনবিড়াল-মাতার দুঃসাহসিক শিকারের কথা বলেছি, সেটাকে পরবর্তীতে বন্দুকের গুলিতে আমার বাবাই মেরেছিলেন। স্বাস্থ্যবতী সেই বনবিড়াল-মাতার দৈর্ঘ ছিল ১৮ ইঞ্চি হাতের মাপে দুই হাতের বেশি। লেজটি ছিল এক হাত। ওটার ৪টি বাচ্চা এনে আমরা চারজনে পুষেছিলাম ১৪ মাস। তারপর জঙ্গলের ডাকে হারিয়ে গিয়েছিল একদিন। বনবিড়ালরা গ্রামবাংলার নানা অঞ্চলে নানান রকম স্থানীয় নামে পরিচিত। যেমন ওয়াপ, বাওড়াল, জংলিবিড়াল ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ বাঘ যেমন হাঁক ছেড়ে ছেড়ে বাঘিনীকে খোঁজে, বনবিড়ালও সঙ্গিনীর খোঁজে 'ওয়াপ ওয়াপ' শব্দে ডাকে। শীত-গ্রীষ্ফ্ম এদের প্রজনন কাল। গর্ভধারণ কাল ৬৩-৬৬ দিন। ছানা হয় ৩-৫টি। ছানারা মায়ের সঙ্গে পোষা বিড়াল ছানার মতোই খেলা করে। সুযোগ পেলে পোষা পুরুষ বিড়ালের মতো পুরুষ বনবিড়ালও ছানাদের মেরে ফেলে। বাঘ যেমন ছানা স্থানান্তর করে বেশ কবার, বনবিড়ালও সে রকম করে। নিরাপত্তার প্রকট সংকট দেখলে মোটা গাছে চড়ে ছানাদের ৬-৭ ফুট উচ্চতার খোঁড়লে-কোটরে রাখে।

আমার বাল্য-কৈশোরে ও তরুণবেলায় বনবিড়াল ছিল নিত্যপ্রতিবেশী। বর্ষাকালে খুবই অত্যাচার করত। গুলি করে মেরেছি আমিও। একবার মীর বাড়ির এক চাচা মেছোবাঘ বা শিয়াল ধরা বক্স-ফাঁদে একটি বনবিড়াল আটকে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে এনেছিলেন। মজা দেখার জন্য কৌশলে ওটার লেজের গোড়ায় হাত তিনেক লম্বা দড়ি বেঁধে- দড়ির আরেক প্রান্তে বেঁধে দিয়েছিলেন একটা নারকেলের 'মালা' বা আঁচা। তার পরে ফাঁদের মুখ খুলতেই বনবিড়ালটি দিল দৌড়, কিন্তু পেছনে আসা মালার 'ঠকঠক' শব্দটাকে 'আজব শত্রুর তাড়া' ভেবে ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার দশা। এ এক দারুণ মজার কাণ্ড! বিড়ালটি দৌড়াবে 'জীবনবাজি' দৌড়- শব্দ শত্রু তো পেছনে করছে ধাওয়া! এ রকম ক্ষেত্রে একটি বিড়ালের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে আতঙ্কে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সেদিন যা একটা মজা পেয়েছিল না! শিয়াল-গরু ও পোষা বিড়ালের লেজে দড়ি বেঁধে অপর প্রান্তে শব্দ সৃষ্টিকারী ঘটি বাটি বা বদনা বেঁধে দিলেও আতঙ্কে দৌড়াতেই থাকবে। পেছনে যে তেড়ে আসছে অজানা শত্রু! তবে, এটা করা একদম উচিত নয়। উচিত নয় কোনো বন্যপ্রাণীকে মারা বা কষ্ট দেওয়া অথবা পোষা। বনবিড়ালরা ধেনো ইঁদুর খেয়ে কৃষকের অনেক উপকার করে। বিষধর সাপকে মেরে ফেলে কৌশলে। বাল্য-কৈশোরে স্কুল ছুটির দিনে আমরা কুকুর বাহিনী নিয়ে বন-বাগানে ঢুকতাম বন্যপ্রাণী তাড়াতে ও মারতে। ছুটির দিনের মজার খেলা আর কী! না বুঝে সেদিন আমরা ভয়ংকর অপরাধ করেছি। বনবিড়াল আজও আছে গ্রামবাংলায়।

বনবিড়ালের থাবার নিচে শিকার, পিঁড়িতে বেলুনে রুটি বেলার মতো বেলে মারছে শিকার- সেই শিকার একটু ভারী হলে ডান থাবা উঁচিয়ে শিকারকে উঁচুতে রেখে তিন পায়ে লাফিয়ে পালাচ্ছে একটি বনবিড়াল, এমন দৃশ্য গ্রামবাংলায় যারা দেখেছেন, তাদের ভোলার কথা নয় কোনোদিন। হাঁস-মুরগির খোপের ফাঁকফোকর দিয়ে যদি ভেতরে ঢোকাতে পারে থাবা, থাবার নাগালে পড়া হাঁস-মুরগির মাথা-পা এক টানে ছিঁড়ে বাইরে আনার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে বনবিড়ালের। মুণ্ডুবিহীন মুরগি তড়পাচ্ছে আর লাফাচ্ছে, রক্ত ছিটাচ্ছে চারপাশে, এ রকম দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্যও আমার হয়েছে।