প্রতিবন্ধকতা জয় করে মুন্না এখন 'রিয়েল হিরো'। তার অর্জনের ঝুলিও বেশ ভারি। প্রতিযোগিতার এ যুগে ছোটার শক্তি না থাকলেও থেমে নেই এগিয়ে চলা। হুইলচেয়ারেই ছুটে চলেছেন তিনি। অদম্য এ যুবক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের হয়ে জিতে এসেছেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও। অথচ একটা সময় তার বেঁচে থাকার আশাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। সড়ক দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পেয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন হেদায়েতুল আজিজ মুন্না। চিকিৎসকরা আশা ছাড়েননি, তবে বাঁচবেন কিনা- এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণাও দিতে পারছিলেন না। পরে কোমা থেকে ফিরলেও হারিয়ে ফেলেন চলার শক্তি। তাতেও দমে যাওয়ার পাত্র নন মুন্না। যেখানে বাঁচা-মরাটাই ঝুলে গিয়েছিল সূক্ষ্ণ একটি সুতার ওপর, সেখান থেকে দশ দিক মাতিয়ে মুন্না দেখিয়ে দিয়েছেন- এভাবেও ফিরে আসা যায়। আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী ও পঙ্গুত্ব বরণ করা ব্যক্তিদের এখনও বোঝা মনে করা হয়।
সেখানে সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে মুন্না নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক ভিন্ন যোগ্যতায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে মুন্না নিয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের বর্ণিল আয়োজনে তাকে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ক্যাটাগরিতে এ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রিয়েল হিরোস অ্যাওয়ার্ড, ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্সি অ্যাওয়ার্ড, সমাজসেবা অ্যাওয়ার্ড এবং ভারতের উচ্চ পর্যায়ের সম্মাননা অশোকা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি।
যত সহজে কথাগুলো বলা, মুন্নার পথচলা ততটা সরল ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে স্নাতকে ভর্তিও হয়েছিলেন। ২০০৩ সালে সৌদি আরবের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি হলে পড়াশোনা থামিয়ে দিয়ে সেখানে পাড়ি জমান। চাকরির পাশাপাশি নিজের ব্যবসাও ছিল তার। ভালোই কেটে যাচ্ছিল জীবন। কিন্তু ২০০৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনা তার সব আশা দুমড়ে-মুচড়ে দেয়।
সে সময়ের ঘটনা বেশ দৃঢ়কণ্ঠেই বলছিলেন মুন্না। গলার স্বরেই বোঝা যায়, জীবনের মর্মান্তিক সত্য মেনে নিয়েছেন তিনি। বলেন, সে বছর আগস্টের শুরুতে নিজে গাড়ি চালিয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি কোমায় চলে গিয়েছিলেন। ২২ দিন কোমায় থাকার পর পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে আনা হয়। এখানকার হাসপাতালে আরও ২২ দিনের মতো কোমায় ছিলেন।
মুন্না বলেন, মাস দেড়েক পর জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারি, আমি হাঁটাচলার শক্তি হারিয়েছি। স্পাইনাল কর্ডে ইনজুরির কারণে আমাকে চিরপঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে। অবস্থার উন্নতির আশায় সাভারের সিআরপিতে বহুদিন ফিজিওথেরাপিসহ বিভিন্ন চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
তিনি জানান, শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে বাড়ি ফিরে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করেন। বাধা ছিল তার প্রতিবন্ধকতা। নিজেই স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না; হুইলচেয়ারে চলতে হয়; কীভাবে কী করবেন! অনেক ভেবে মুন্না চ্যালেঞ্জ নিলেন, নিজে যখন প্রতিবন্ধিতা নিয়ে সংগ্রাম করছেন, সামনের দিনগুলোতে প্রতিবন্ধীদের জন্যও কিছু করবেন।
কাজ শুরু করতে গিয়ে মুন্না অনুভব করলেন, তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হলে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। এর পর তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মা ও শিশুর প্রতিবন্ধিতা এবং প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে সংক্ষিপ্ত গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পরে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিষয়ে ডিএইচএমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এসবের মাঝে ব্যক্তিগত জীবনকেও গুছিয়ে নিচ্ছিলেন মুন্না। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে গিয়ে পরিচয় হয় থেরাপিস্ট লাকী আক্তারের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম। এক পর্যায়ে তাকেই বিয়ে করেন মুন্না। দেড় বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে এ দম্পতির।
ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি স্বপ্নকেও ফিকে হতে দেননি মুন্না। পরিবার ও কাছের মানুষদের কাছ থেকে অফুরন্ত ভালোবাসা, প্রেরণা ও উদ্যম নিয়ে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ড্রিম ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন (ডিডিএফ)। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মুন্না বলেন, এ সংগঠনের মাধ্যমে আমি আমার দলকে নিয়ে প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে পুরোদমে কাজ শুরু করি। প্রতিবন্ধী মেধাবী তরুণদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে একটি একীভূত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে কম্পিউটারসহ নানা কারিগরি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিই। এখানে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে পেরেছি আমরা। এসবের বাইরে আমরা ক্রিকেট নিয়েও কাজ করেছি। এ সংগঠনের অধীন ডিডিএফ হুইলচেয়ার ক্রিকেট টিম বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করে ভারতের হুইলচেয়ার ক্রিকেট টিমকে হারিয়ে দু'বার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছে। এ ছাড়া ডিডিএফ ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট দল এবং ডিডিএফ শারীরিক প্রতিবন্ধী ফুটবল দলও গঠন করেছি।
খেলাধুলাকেই কেন বেছে নিলেন সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে- এ প্রশ্নে মুন্নার সরল উত্তর- দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বলেন, আমাদের কেউই স্বাভাবিক চোখে দেখে না। আমরা যে কাজ করতে পারি, কম্পিউটার চালাতে পারি- সেটাই মানুষ ঠিকমতো জানে না। খেলাধুলার প্রতি সবার আগ্রহ আছে। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের বড় কর্তারা আমাদের খেলায় অতিথি হিসেবে আসেন। এখান থেকে পরিচয় তৈরি করে আমরা অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছি। মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার উদ্দেশ্য থেকেই এসব উদ্যোগ।
মুন্নার সাফল্যগাথা এখানেই থেমে যায়নি। বছরজুড়ে শিক্ষা, সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়মিত অনুপ্রাণিত করে চলেছেন তিনি। করোনা মহামারিতে যেখানে অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বাসার বাইরে বের হননি, সেখানে মুন্না হুইলচেয়ারে ছুটেছেন দেশের নানা প্রান্তে। সংকটের এই সময়ে তিনি ও তার দল বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিতরণ করেছেন খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী।
মুন্না বলেন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি অর্জন এবং কর্মক্ষম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করে তোলাই আমার লক্ষ্য। যারা প্রতিবন্ধী, আমি তাদের বলব- আপনারা সবাই মুন্না। আমি যদি এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আপনারাও পারবেন। তবে, আপনারা কারও কাছে গিয়ে টাকা বা হুইলচেয়ার চাইবেন না। যদি চাইতেই হয়, তাহলে নিজের যোগ্যতা দিয়ে চাকরি চাইবেন। তাহলেই সবার চোখে আপনি সম্মান অর্জন করতে পারবেন।
নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, আমি দেখতে চাই, দেশের প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সমাজের মূলধারায় উঠে এসেছে; সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে।
মুন্নার স্বপ্ন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিবন্ধীবিষয়ক উপদেষ্টা হওয়া, এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী কাজ করা। মাটির সমান্তরাল থেকে যে মুন্না উঠে এসেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, তার স্বপ্নটা আকাশছোঁয়া হবে- এই তো স্বাভাবিক।



বিষয় : বাংলাদেশের হৃদয় হতে

মন্তব্য করুন