'নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো গলদ নেই', 'মাঠ প্রশাসন তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করছে', 'ভোটার কেন্দ্রে না গেলে ইসির কী করার আছে'- এমন সব বিতর্কিত বক্তব্য সবসময়ই দিয়ে আসছে নির্বাচন কমিশন। এবার চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে অব্যাহত সহিংসতা আর প্রাণহানির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিব্রত বোধ করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তবে বিশ্নেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী ইসি নিজেই। সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ নির্বাচনে অনিয়ম। এসব অনিয়ম বন্ধে ইসি কখনোই আন্তরিক ছিল না। সহিংসতা বন্ধেও কোনো উদ্যোগ চেখে পড়েনি।
নির্বাচন-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন শুরু থেকেই একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবং অবস্থান নিয়েছেন। অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তারা অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। যে কারণে এখন অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে জয়লাভের প্রবণতা বাড়ছে। একই কারণে অনেকটা বিরোধীপক্ষের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনাও অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এবারের ইউপি ভোটে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে মাঠে নেই বিএনপি। অধিকাংশ ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। ইউপি সদস্যপদে দলীয় প্রতীক না থাকলেও এ নিয়ে উত্তেজনার কমতি নেই। এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। করোনাকালেই প্রথম ধাপের ইউপি ভোট অনুষ্ঠিত হয়। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ভোটে আওয়ামী লীগের অন্তত ৩৮ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।
দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউনিয়নে ১১ নভেম্বর এবং তৃতীয় ধাপের এক হাজার ৭টি ইউনিয়নে ২৮ নভেম্বর ভোট নেওয়া হবে। প্রথম ধাপে ২১ জুন ২০৪টি ইউপি ও ২০ সেপ্টেম্বর ১৬০টি ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউপি নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। হয়ে যাওয়া নির্বচনগুলোর দিকে তাকালে সহিংসতার মাত্রা সামনে আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্নিষ্টদের আশঙ্কা। এ সময়ে ইসির মাঠ প্রশাসনের সঙ্গ বৈঠক ছাড়া আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, 'পুরো মেয়াদ চেয়ার আঁকড়ে থেকে মেয়াদ পূরণের আড়াই মাস আগে বিব্রত হলে জনগণের কী লাভ! বর্তমান কমিশনের সদস্যরা এতদিন একজনের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। আর এখন এসে বলছেন, তারা বিব্রত।' তিনি বলেন, তাদের কথা কেউ শুনছেন না। তাদের মাফ চেয়ে বাড়ি চলে যাওয়া উচিত। পুরো নির্বাচন সিস্টেমটাই তারা ধ্বংস করে দিয়েছে।
সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচনী সহিংসতা বন্ধে রাজনৈতিক দল তাদের কথা শুনছে না। পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসন এমনকি মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনী কর্তাদের ওপরেও বর্তমান কমিশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাংবিধানিক একটি ইনস্টিটিউশনকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছেন তারা। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করে উল্টো কমিশনের আইনগত কর্তৃত্ব খর্ব করতে কাজ করছেন।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, জনগণ বা সিংহভাগ ভোটার ভোট নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, যদিও কমিশন সদস্যরা তা মানতে রাজি নন। মাঠ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান দেখিয়ে তারা এতদিন গর্ববোধ করছেন। নির্বাচন ঘিরে শত অভিযোগ ও নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির তথ্যপ্রমাণ থাকলেও এর কোনোটিই মানতে রাজি নয় কমিশন। একশ ভাগ ভোট পড়ার মতো ভোট জালিয়াতির প্রমাণ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। আইনের দোহাই দিয়ে সেসব অভিযোগ তাৎক্ষণিক বাতিল করা হয়েছে। তারা আন্তরিক হলে জালিয়াতি, অনিয়ম ঠেকানো সহজ হতো।
চলমান ইউপি ভোটের অনিয়ম ও সহিংসতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কয়েকটি নির্বাচনী এলাকা থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে প্রমাণিত- ইসির অনেক মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিজেরাই কমিশনের এখতিয়ার থেকে বেরিয়ে গিয়ে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা প্রভাবিত এবং তাদের নির্দেশ পালন করছেন। এখন ইলেকশন নয়; সিলেকশন করতে হচ্ছে কথিত রিটার্নিং কর্মকর্তাদের। কমিশনের পরিবর্তে এখানে মুখ্য ভূমিকায় স্থ্থানীয় সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা। এ অবস্থার কারণ কমিশনের নিষ্ফ্ক্রিয়তা। এ ধারার মধ্যে আগামী নির্বাচন কমিশনের দুর্গম পথে হাঁটতে হবে। কারণ, ক্রমেই নির্বাচনের অর্থ বদলাচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আইনে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়ার পরও বিগত পাঁচ বছরে ইসি কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে- এমন নজির নেই। বর্তমান কমিশন অন্যায়কে উৎসাহিত করেছে। পাশাপাশি নিজেরাও অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। নির্বাচনী অনিয়ম বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আন্তরিকতা, যোগ্যতা, সততা বা দক্ষতা- কোনোটাই এই কমিশনের নেই।
তিনি বলেন, অন্যায় করে কেউ পার পেয়ে গেলে সে তো আরও অন্যায়ে উৎসাহিত হবে। অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন বন্ধ বা বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের হাতে রয়েছে। কিন্তু তার কোনো প্রয়োগ নেই। যে কারণে পুলিশ বা সিভিল প্রশাসন দূরের কথা, এখন ইসি কর্মকর্তারাই কমিশনের নির্দেশ পালন করছেন না। বেশ কয়েকটি স্থানে ইসির মাঠ কর্মকর্তারা রাজনৈতিক দলের নেতাদের নির্দেশ বাস্তবায়নে সক্রিয়- এমন অভিযোগ উঠেছে।
বদিউল আলম বলেন, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম কমিশন এটি। তাদের লজ্জা নেই। লজ্জা থাকলে তারা অনেক আগেই পালিয়ে যেত।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বারবার প্রমাণ দিয়েছে- তার ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থ। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু একটি ঘটনায়ও তারা শক্ত অবস্থান নেননি। উল্টো খুবই দুর্বল যুক্তি দিয়ে বিষয়গুলো জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন। তাদের চিন্তা, যুক্তি ও পদক্ষেপ- সবই শুরু থেকে খুবই দুর্বল ছিল।
তিনি বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। একদিকে মানুষের ভোটাধিকার হরণ, আরেকদিকে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। নির্বাচন ব্যবস্থায় এখন দলীয় বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা যেদিকে, সবাইকে সেদিকেই থাকতে হবে- এমন একটা প্রবণতা সবার মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ের ইসি কর্মকর্তাদের ওপর কমিশনের নিয়ন্ত্রণ হারানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান কমিশনের সদস্যরা কেন্দ্রীয়ভাবে দলীয় আদেশে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারই প্রভাব এখন মাঠ পর্যায়ে পড়েছে। এখন ইসির মাঠ কর্মকর্তারাও কমিশনের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতাদের আদেশ পালন করছেন।



বিষয় : বিব্রত নির্বাচন কমিশন

মন্তব্য করুন