
সুন্দরবনের দুবলারচরে নৌকা থেকে মাছ নামানোর কাজে ব্যস্ত জেলেরা- প্রতিবেদক
ভরা জোয়ার। নদীর দু'কূল ছাপিয়ে জলরাশির ঢেউ খেলে যাচ্ছে সুন্দরবনে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদীর সঙ্গে সুন্দরী ও কেওড়া গাছের মিতালিতে অনিন্দ্যসুন্দরের আহ্বান কার না মন কাড়ে! তার মধ্যে দুবলারচরে মাছ ধরছেন জেলেরা। জাল থেকে মাছ দ্রুত ট্রলারে তুলতে ব্যস্ত তারা। এসব দৃশ্যের আড়ালে তাদের ভাগ্য নিয়ে খেলা করা 'সাহেব' নামে একটি চক্রের প্রহসন সভ্যতার আলোতে থাকা মানুষের জন্য এক অজানা অধ্যায়।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বজুড়ে দুবলারচর। চর-ঘেঁষে বয়ে গেছে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদ। চরটি মূলত জেলে ও শুঁটকিপল্লি হিসেবে পরিচিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পুণ্যস্নানের জন্য এর আলাদা পরিচিতি আছে। প্রতি বছর কার্তিক থেকে পরবর্তী পাঁচ মাস জেগে থাকে দুবলারচর। এ সময় এখানে অস্থায়ীভাবে বসতি তৈরি করেন অন্তত ৪০ হাজার জেলে ও মৎস্যজীবী। বঙ্গোপসাগর ছাড়াও সুন্দরবন সংলগ্ন নদী থেকে শিকার করা মাছ ঘিরে চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এরপর আবার 'মরে' যায় এই চর। বছরের বাকি সময় থাকে প্রাণহীন।
বিচ্ছিন্ন এই চরের জেলেদের রয়েছে চাপা কষ্ট। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট নানা সংকটও তাদের মোকাবিলা করতে হয়। বছরের পর বছর ধরে প্রভাবশালী একটি চক্রের কাছে জিম্মি তারা। এই চক্রের হর্তাকর্তাদের জেলেরা 'সাহেব' বলে ডাকেন। বাঘ ও জলদস্যুদের চেয়ে ভয়ংকর এই সাহেবরা। দাদনের সুদের চক্র এবং নির্দিষ্ট আড়তে মাছ বিক্রি করাসহ জেলেদের জীবিকার নিয়ন্ত্রক হয়ে বসেছে তারা। ভুক্তভোগীরা জানালেন, এই চর নিয়ন্ত্রণ করে কথিত ১৪ সাহেব।
ইঞ্জিনচালিত ট্রলার থেকে কাঠের ছোট্ট জেটি পার হয়ে দুবলারচরের মূল ভূখণ্ডে পা রাখার আগেই শুঁটকির ঘ্রাণ বলে দিচ্ছিল এই চরের বৈশিষ্ট্য। প্রথমে দেখা গেল ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি লইট্যা মাছ শুকাতে ব্যস্ত। তাজা লইট্যা বাঁশের মাচার ওপর বেঁধে দিচ্ছিলেন। তার নাম গাউছ গাইন। বাড়ি খুলনার পাইকগাছায়। মাসে ১০ হাজার টাকা চুক্তিতে পাঁচ মাসের জন্য শুঁটকি বানানোর কাজ নিয়েছেন। মূল ব্যবসাটি তার জামাতা শফিকের। গাউছ গাইন বলেন, 'গ্রামে কাজ কম। অর্থকষ্টে আছি। এবারই প্রথম শুঁটকির কাজ নিয়েছি। বয়স হয়ে গেছে। সবাই সব কাজ দিতে চায় না।'
গাউছ জানান, প্রতি মণ কাঁচা লইট্যা গড়ে এক হাজার ৬০০ টাকায় কেনা হয়। শুকাতে চার-পাঁচ দিন লাগে। এরপর কেজি দরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার থেকে পাইকার বা তাদের লোকজন এসে তা নিয়ে যায়। মণপ্রতি লইট্যার শুঁটকি ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
প্রায় ৮১ বর্গমাইলের দুবলারচরের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকলে দেখা যায় নানা ধরনের মাছ শুকানোর বিরাট কর্মযজ্ঞ। এখানে চিংড়ি, রূপচাঁদা, ছুরিসহ সামুদ্রিক নানা প্রজাতির মাছ শুকানোর কাছে ব্যস্ত শত শত মানুষ। সেখানে কথা হয় এই চরের চার দশকের বাসিন্দা নারায়ণ বিশ্বাসের সঙ্গে (৭০)। বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। শুঁটকির ব্যবসা ছাড়াও তার রয়েছে মাছ ধরার নিজস্ব ট্রলার। দুই ছেলেকেও এই কাজে যুক্ত করেছেন। সব মিলিয়ে তার ব্যবসায় যুক্ত আটজন। সাধারণত কার্তিক থেকে চৈত্র পর্যন্ত দুবলারচরে কর্মব্যস্ততা থাকে। জেলেদের ভাষায় এই পাঁচ মাস হলো মাছের 'গোন'।
নারায়ণ বিশ্বাস জানান, বিএলসি বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ্বালানি কাঠ) কনজাম্পশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বন বিভাগকে রাজস্ব দিয়ে মৎস্য ব্যবসায়ীরা সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান। দুবলারচরে যারা পাঁচ মাসের জন্য আসেন, বন বিভাগকে নির্দিষ্ট রাজস্ব দিয়ে জায়গা বন্দোবস্ত নিতে হয়। চরের ভেতরে ছোট ছোট টং ঘর তৈরি করে মৎস্যজীবীরা থাকেন। অনেক ঘরে সৌরচালিত বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। একসঙ্গে এক-দুই মাসের চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসেন তারা। অনেকে জানান, দুবলারচরে 'নিউমার্কেট' নামে একটি বাজার রয়েছে। সেখানে শতাধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকেও কেউ কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন। গত ৪০ বছরে তিনবার জলদস্যুদের কাছে জিম্মি হন নারায়ণ। তবে ভাগ্যক্রমে বড় বিপদ ছাড়াই মুক্তি পান। তবে ২০১৬ সালের পর থেকে জলদস্যুদের তেমন আনাগোনা এ এলাকায় নেই। প্রতি বছর অন্তত ৪০ হাজার মৎস্যজীবী কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে এসে পাঁচ মাসের জন্য সেখানে থাকেন বলে জানান নারায়ণ।
ফণী মণ্ডল নামে এই চরের আরেক মৎস্যজীবী জানান, নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চরে তাদের দিন কাটে। অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্রাম্য চিকিৎসক থাকলেও প্রয়োজনে তারা খুব একটা কাজে আসেন না। এমনকি সংকটাপন্ন কাউকে দ্রুত চর থেকে ডাঙায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য দ্রুতগামী জলযানের ব্যবস্থাও নেই। সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে নিরাপদ স্থাপনায় থাকার মতো ব্যবস্থা নেই। এমন পরিস্থিতিতে জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় নৌকায়।
ফণী মণ্ডল বলেন, অন্তত পাঁচ মাসের জন্য সরকার এখানে অস্থায়ীভাবে হাসপাতাল বা মেডিকেল ক্যাম্প করে দিলে অনেক দুর্ভোগ কমবে। সুপেয় পানির জন্য চরে পুকুর খনন করা দরকার। দুবলারচরে শুধু টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও তা খুবই দুর্বল।
বরুণ দে নামে আরেক মৎস্যজীবী জানান, চরের অনেকে দাদনের ওপর নির্ভরশীল। খুলনা, সাতক্ষীরার বড় পাইকারদের কাছ থেকে দাদন এনে মাঝারি ও ছোট মৎস্যজীবীরা দুবলারচরে পাঁচ মাস ব্যবসা করেন। দাদন চক্রের কারণে নির্দিষ্ট আড়তে মাছ বিক্রি করতে হয় তাদের। আর ৩ শতাংশ বাড়তি কমিশনও দেওয়া লাগে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মৎস্যজীবী জানান, মূলত দুবলারচর যে ১৪ 'সাহেব' জিম্মি করে রেখেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন- কামাল উদ্দিন, সফিউল্লাহ খোকন, মাইনুদ্দিন টোকন, জালাল আহমেদ, মো. শামীম, রাজা, আজিবর, পিন্টু, মিঠু, রেজাউল ও জাহিদুল। দাদনের টাকা সুদসহ জেলেরা পুরোপুরি ফেরত দিলেও অনেক সময় পরিশোধ-সংক্রান্ত রশিদ তাদের দেওয়া হয় না।
চর ঘুরে এখানকার মানুষের জীবনের প্রভাব বিস্তার করা নানা কুসংস্কারের কথা জানা গেল। এই চরে কোনো নারীকে আনা হয় না বা থাকতে দেওয়া হয় না। চরের অস্থায়ী বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন, নারীরা সেখানে গেলে চরটি ঘিরে মাছ তোলার যে বিশাল আয়োজন, তাতে ভাটা পড়বে।
মন্তব্য করুন