ডিজেলের দাম বাড়ার পর ফসলের উৎপাদন খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তাও বেড়েছে কৃষকের। চাষাবাদ করে লাভের আশার চেয়ে লোকসান ঠেকানোর হিসাব মেলানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। উৎপাদন কমে যেতে পারে। এ অবস্থায় ডিজেলের ওপর ভর্তুকি ও কৃষিপণ্যের বাজারমূল্য বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন তারা। পাশাপাশি সেচ ব্যবস্থাপনায় ডিজেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেছেন তারা।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, সরকার কৃষককে নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে সারের দাম বাড়লেও বাংলাদেশে বাড়ানো হবে না। এ ছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতিতে বড় ধরনের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। অনেক কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃষককে ব্যাপকভাবে সহায়তা দেওয়ার ফলে ডিজেলের দাম বাড়লেও কৃষিতে তার প্রভাব পড়বে না। তাই ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান সমকালকে বলেন, ডিজেলের ক্ষেত্রে কৃষককে প্রণোদনা কিংবা ভর্তুকি দিতে হবে। অন্য অনেক জিনিসের দাম বাড়লে তেমন হইচই হয় না, যা কৃষিপণ্যের দাম বাড়ালেই শুরু হয়ে যায়। অথচ এটি কৃষকের প্রাপ্য। পৃথিবীর কোথাও এত কম দামে কৃষিপণ্য বিক্রি হয় না। আমাদের কৃষককে কৃষিকাজে ধরে রাখতে হলে উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয়ও কৃষকের সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে হবে। এভাবে ডিজেলের দাম বাড়লে উৎপাদন-ব্যয় সীমার মধ্যে থাকবে না। বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
সেচ ব্যবস্থাপনায় বিকল্প চিন্তার সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, সেচে পানির অপচয় কমাতে সরকার বেশকিছু কাজ করছে। কিন্তু এটি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচব্যবস্থা প্রচলনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া যায়। আমাদের দেশে দিনের বড় একটা অংশজুড়ে সূর্যের আলো থাকে। এটাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। এই বিকল্পটি হবে সবচেয়ে কার্যকর। তার জন্য হয়তো সময় লাগবে; কিন্তু উদ্যোগ শুরু করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, খাল খননসহ নানা উপায়ে সেচের ব্যবস্থা করা গেলে ডিজেলের ওপর নির্ভরতা কমবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম সমকালকে বলেন, বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়েছে, যা আমাদের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য বিরাট চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। আবার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও একটু ভিন্ন। ডিজেলের দামের সঙ্গে পরিবহন ও কৃষি সরাসরি জড়িত। ফলে ঢালাও ভর্তুকি না দিয়ে খাতওয়ারি দেওয়া যেতে পারে।

কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (কেআইবি) মহাসচিব কৃষিবিদ মো. খায়রুল আলম (প্রিন্স) সমকালকে বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ার প্রভাব সবকিছুর মতো কৃষিতেও পড়বে। কৃষিপণ্যের পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। সামনে বোরো মৌসুম। এ মৌসুমে ব্যবহূত সেচযন্ত্রগুলো ডিজেলে চলে। ফলে সেচের খরচও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকার সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিচ্ছে। নানা প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কৃষি যন্ত্রপাতিতে ৫০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সরকার যদি সহায়তা আরেকটু বাড়ায়, তাহলে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে ক্ষতি কিছুটা কমবে। কৃষকদের কীভাবে স্বল্পমূল্যে ডিজেল দেওয়া যায়, সে বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করতে পারে। বিশেষজ্ঞ, স্টেকহোল্ডার, কৃষকসহ সংশ্নিষ্টদের মতামত নিয়ে সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি আশা করেন।

কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ সমকালকে বলেন, কৃষক ইচ্ছা করলেই দাম নির্ধারণ করতে পারবেন না। কারণ, কৃষকদের নিজস্ব কোনো সংগঠন নেই। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। সরকার কৃষক, ভোক্তা, বিক্রেতা, বিশেষজ্ঞসহ সংশ্নিষ্টদের নিয়ে একটি মূল্য কমিশন গঠন করতে পারে। এ কমিশন কৃষকের উৎপাদন খরচ হিসাব করে প্রতিটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে। যেমন এ মুহূর্তে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর শীতকালীন সবজির দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে। এ ছাড়া কৃষককে মূল্য সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। একজন কৃষক ১০০ মণ আলু উৎপাদন করলে তার বাড়তি খরচ সরকার প্রণোদনা হিসেবে দিতে পারে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে। তবে দাম অতিরিক্ত বাড়লে কিংবা বাজার অস্বাভাবিক হলে আমরা মূল্য নির্ধারণ করব। এ মুহূর্তে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।

প্রতিবেশীর তুলনায় বাংলাদেশে ডিজেলের দাম কম :বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় গত বুধবার রাতে সরকার লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়েছে। এর পরও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে জ্বালানির দাম কম। পরিবহন, কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে ডিজেলের সরাসরি সম্পর্ক থাকায় এই দাম বাড়ার প্রভাব জনজীবনে পড়েছে। সরকারের দাবি, ভর্তুকির চাপ সামলাতে এবং পাচার ঠেকাতে দাম বাড়াতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি ও পরিবহন খাতে সরকারের সঠিক প্রণোদনা ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবকে প্রশমিত করতে পারে। তাহলে দাম বৃদ্ধি নিয়ে চাপে থাকা জনগণ একটু স্বস্তি পাবে।
বাংলাদেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৫০ লাখ টন, যার মধ্যে ৪০ লাখ টনই আমদানি করতে হয়। ডিজেলের মোট চাহিদার ৬৩ শতাংশ ব্যবহূত হয় পরিবহন খাতে। সেচকাজে ব্যবহূত হয় ১৬ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬ শতাংশ ডিজেলচালিত কেন্দ্র।

জ্বালানি বিভাগ বলছে, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে পার্শ্ববর্তী দেশ জ্বালানি তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করছে। বাংলাদেশে এখন প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৮০ টাকা, যা ভারতে (পশ্চিমবঙ্গ) ১১৪ টাকা। ফলে ডিজেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত ডিজেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) লোকসানের সম্মুখীন হয়। ডিজেলে গত জুনে লিটারপ্রতি ২.৯৭ টাকা, জুলাই মাসে ৩.৭০, আগস্টে ১.৫৮, সেপ্টেম্বরে ৫.৬২ এবং অক্টোবরে ১৩.০১ টাকা লোকসান হয়েছে বলে বিপিসি দাবি করেছে। সেই হিসাবে গত সাড়ে পাঁচ মাসে ডিজেলের ক্ষেত্রে বিপিসির লোকসানের পরিমাণ প্রায় এক হাজার ১৪৭ কোটি টাকা, যা ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করতে হবে।