- বাংলাদেশ
- বাস-ট্রাকের পর লঞ্চ বন্ধে মানুষের নাভিশ্বাস
বাস-ট্রাকের পর লঞ্চ বন্ধে মানুষের নাভিশ্বাস

গণপরিবহন বন্ধের দ্বিতীয় দিনেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। বাসস্ট্যান্ড ছেড়ে যায়নি দূরপাল্লার কোনো বাস। এতে করে চরম দূর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। ছবি: মো.রাশেদ
গণপরিবহন বন্ধের দ্বিতীয় দিনেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। শুধু দূরপাল্লার যাত্রীরাই নন, রাজধানীতে অফিস বা কর্মস্থলে যাতায়াত করতে গিয়েও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন অনেকে। মালিকরা লঞ্চ চালানো বন্ধ রাখলে গতকাল শনিবার দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের নাভিশ্বাস ওঠে। সদরঘাট লঞ্চঘাট ঘুরে মানুষের দুর্ভোগের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়।
'কী বিপদে যে পড়ছি ভাই! অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল দেশের (গ্রামের) বাড়িতে পারিবারিক অনুষ্ঠান। আজকেই (গতকাল শনিবার) যাওয়া দরকার। এদিকে ধর্মঘট পরিস্থিতিতে এই হাল।' বলছিলেন মধ্যবয়সী সাইফুর রহমান। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যানবাহনের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। যাবেন নওগাঁ শহরে। কিন্তু বাস বন্ধ থাকায় পড়েন বিপাকে। টার্মিনালের অদূরে লক্কড়ঝক্কড় কিছু প্রাইভেটকার দূরের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছিল। অন্য সময় এগুলো কাছের দূরত্বে চলাচল করলেও এখন বহুগুণ বেশি ভাড়ায় বগুড়া বা রংপুরের মতো দূরত্বেও যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উপায় না পেয়ে সাইফুর বগুড়াগামী গাড়িটির যাত্রী হন। পরে বগুড়া থেকে নওগাঁ যাওয়ার অন্য কোনো ব্যবস্থা করবেন বলে জানালেন। তিন সদস্যের পরিবারের প্রত্যেকের জন্য তাকে ভাড়া গুনতে হচ্ছে এক হাজার টাকা করে। অথচ বাসে যেতে পারলে ভাড়া দিতে হতো ৩৫০ টাকা করে। শুধু এই পরিবারই নয়, বাস বন্ধ থাকায় শুক্রবারের মতো গতকালও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বহু মানুষকে। এর মধ্যে দূরের যাত্রী যেমন আছেন, তেমনি আছেন ঢাকা শহরের ভেতর বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া ব্যক্তিরা। বাস বন্ধ থাকায় ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ অন্যসব যানবাহনের কদর বেড়েছে। তারাও সুযোগ বুঝে ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকছেন। বিকল্প না থাকায় সেই ভাড়াতেই যেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। গণপরিবহন না থাকলেও গতকাল ঢাকায় রাস্তায় তীব্র যানজট দেখা যায়। প্রাইভেটকার, রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশার জটলা ছিল মোড়ে মোড়ে।
গাবতলী বাস টার্মিনালের সামনের সড়কে গতকাল দুপুরে দেখা যায় নানা বয়সী মানুষের ভিড়। কথা বলে জানা গেল, তারা সবাই বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই পরিবহন ধর্মঘটের কথা জানতেন, তবে আশা ছিল বিকল্প ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সেই ব্যবস্থা অবশ্য ছিলও। টার্মিনাল ছাড়িয়ে গাবতলী সেতুর দিকে এগোতে দেখা যায় নানারকম যানবাহন। এমনকি লেগুনাও দূরের যাত্রী বহন করছে।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আবদুর রাজ্জাক সপরিবারে যাবেন সাভারের বিশমাইল এলাকায়। সেখানেই তার গ্রামের বাড়ি। তিনি সমকালকে জানালেন, ভাঙাচোরা ছোট প্রাইভেটকার সব সময়েই চলে। তিনি গাড়িও পেয়ে গেলেন। কিন্তু যাত্রীর চাপ থাকায় ভাড়া হাঁকা হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। অন্য সময় তিনি ৪০০ টাকায় গেলেও এখন চাওয়া হচ্ছে ৯০০ টাকা। দরাদরির একপর্যায়ে রফা হয় ৮০০ টাকায়।
মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার উদ্দেশে বেশ কিছু প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ছেড়ে যেতে দেখা যায়। প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। অথচ এই রুটে বাসভাড়া ১০০ টাকা। গাবতলী ব্রিজের ঢাল থেকে সাভারের বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছিল লেগুনা।
বগুড়াগামী একটি মাইক্রোবাসের (ঢাকা মেট্রো চ ১৫-৫৪২৫) চালক জানালেন, ১২ সিটের গাড়িতে তারা ১৫-১৬ জন যাত্রী নিচ্ছেন। এক হাজার টাকা করে নিচ্ছেন ভাড়া। কারণ এর চেয়ে কম নিলে তাদের পোষাবে না।
গাবতলী সেতুর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মাইক্রোবাসে (ঢাকা মেট্রো চ ১৩-৫৭১৯) মাগুরাগামী যাত্রীদের ডেকে তোলা হচ্ছিল। জানা গেল মাথাপিছু ৮০০ টাকা ভাড়া। সেতু পার হয়ে আমিনবাজার অংশে গিয়ে দেখা যায়, সেখান থেকেও অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে মানুষ।
আমিনবাজারে দায়িত্ব পালন করছিলেন সাভারের ভাকুর্তা পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নজরুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, বাস বন্ধ থাকায় সড়কে প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাসসহ অন্যান্য পরিবহন ছিল চোখে পড়ার মতো। সেগুলো ভাড়ায় যাত্রী বহন করছে।
এদিকে ঢাকার ভেতরে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতেও দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। বাস না থাকায় প্রধান যান হয়ে ওঠে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও চুক্তিভিত্তিক মোটরসাইকেল। রাইড শেয়ারিং অ্যাপে প্রাইভেটকার বা মোটরসাইকেল পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। বারবার চেষ্টা করেও না পাওয়ায় অনেকে চুক্তিতে গন্তব্যে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে চালক খেয়ালখুশিমতো কয়েক গুণ ভাড়া নিচ্ছেন। এমনকি অ্যাপেও ভাড়া আসছে অস্বাভাবিক বেশি। তবে সব ছাপিয়ে রাজপথ ছিল রিকশার দখলে।
পাঠাও চালক আসিকুর রহমান জানালেন, তিনি মিরপুরের ইসিবি চত্বর থেকে শান্তিনগরে হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে নিয়ে গেছেন এক শিক্ষার্থীকে। যাত্রার শুরুতে অ্যাপে তার ভাড়া দেখানো হয় ১৯৮ টাকা। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে সেই ভাড়া হয়ে যায় ২৯৮ টাকা। ফলে এ নিয়ে বাধে বাগ্বিতণ্ডা। যানবাহনের চাহিদা ও চাপ বিবেচনায় পাঠাও কর্তৃপক্ষ এলাকাভিত্তিক ভাড়া বাড়িয়েছে বুস্ট করার কায়দায়।
তিনি নিজের মোবাইল ফোনের অ্যাপ থেকে দেখান, গতকাল প্রায় পুরো ঢাকা শহরেই ৫০ শতাংশের বেশি পর্যন্ত ভাড়া বুস্ট করা ছিল।
ফার্মগেট মোড় ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে যানবাহনের আশায় বহু মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে বিআরটিসির দু-একটি বাসের দেখা মিললেও তাতে পা রাখার জায়গা ছিল না। এর মধ্যেই যারা ঠাসাঠাসি করে গেছেন, তাদের ভাড়া নেওয়া হয় দ্বিগুণ। ফার্মগেট থেকে গাবতলীর ভাড়া ১৫ টাকা হলেও গতকাল নেওয়া হয় ৩০ টাকা।
সদরঘাট চিত্র: রহিমা বেগমের কোলে এক সন্তান, সঙ্গে আরেক ছেলে। সাভারের একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন। সেখানে স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন। বরগুনার আমতলীতে বাবার বাড়ি। হঠাৎ করে বাবা অসুস্থ হওয়ায় সাভার থেকে সিএনজি অটোরিকশায় বাড়তি ভাড়া দিয়ে সদরঘাটে আসেন। কিন্তু এসে জানতে পারেন লঞ্চ বন্ধ। নদীপথ ও সড়কপথে কোনোভাবে বরিশাল যাওয়ার উপায় নেই। পুরান ঢাকার আশপাশে আত্মীয়স্বজন কারও বাসাও নেই। তাই বাধ্য হয়ে রাতেই সাভারে ফিরতে হবে।
এ ঘটনা শুধু রহিমার নয়, গতকাল সদরঘাটে আসা কয়েক হাজার যাত্রীর একই অবস্থা। গত শুক্রবার থেকে সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ হলেও লঞ্চ চালু ছিল। গতকাল শনিবার দুপুরে সদরঘাটে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার কার্যালয়ে সাধারণ লঞ্চ মালিকদের সভা শেষে মালিকরা লঞ্চ না চালানোর অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তবে সংগঠনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বিকেল সাড়ে ৩টার পর থেকে সদরঘাটের টার্মিনাল থেকে লঞ্চ সরিয়ে নেওয়া হয়। হঠাৎ লঞ্চ বন্ধে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যাত্রীদের ভোগান্তির উল্টোপথও সইতে হয়।
লঞ্চ মালিকদের সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাপ) সংস্থার প্রেসিডেন্ট মাহাবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম সাংবাদিকদের বলেন, 'গতকাল আমরা চিঠি দিয়ে পরিস্কার বলে দিয়েছি, ভাড়া বাড়াতে। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিয়ে আমাকে বলেছিলেন দুপুর ১২টার মধ্যে জানাবেন। তিনি কোনো খবর নেননি, একটা ফোন পর্যন্ত করেননি। আমার সঙ্গে এখানে সাধারণ লঞ্চ মালিকরাও বলছেন, তাদের তেল কেনার টাকা নেই। এই অবস্থায় আমরা কেউই লঞ্চ চালাতে পারব না।'
তিনি বলেন, লঞ্চ চলাচল বিষয়ে কারও ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। লঞ্চ মালিকদের দাবি বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে। ভাড়া বাড়ানোসহ দাবিগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত মালিকরা লঞ্চ চালাবেন না।
এদিকে, লঞ্চ ধর্মঘটের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ রোববার লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক ডেকেছে বিআইডব্লিউটিএ। বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর মতিঝিলের বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে লঞ্চভাড়া সমন্বয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক।
এর আগে শুক্রবার দুপুরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাপ) সংস্থার জরুরি সভায় ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে লঞ্চভাড়া শতভাগ বৃদ্ধির দাবি তোলা হয়। পরে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব লিখিতভাবে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়। এই দাবি পূরণে শনিবার দুপুর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন লঞ্চ মালিকরা।
লঞ্চ মালিকদের ভাষ্য, জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে তাদের পক্ষে লঞ্চ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। তাই লঞ্চভাড়া শতভাগ বাড়াতে হবে। এজন্য যাত্রীবাহী লঞ্চের বিদ্যমান যাত্রীভাড়া ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১ টাকা ৭০ পয়সার স্থলে ৩ টাকা ৭০ পয়সা এবং ১০০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে ১ টাকা ৪০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক জয়নুল আবেদীন বলেন, সকাল থেকে ৩০টি লঞ্চ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। আরও ৩৫টি লঞ্চ পন্টুনে ছিল। কিন্তু বিকেলে লঞ্চগুলো পন্টুন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দুর্ভোগ: রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকায় থাকেন মো. সজল (৩৬)। ছোট বোনের বিয়ের জন্য পটুয়াখালী যাবেন। সঙ্গে স্ত্রী ও ছোট সন্তান। সিএনজি অটোরিকশায় ৬০০ টাকা দিয়ে এসেছেন সদরঘাট পর্যন্ত। এসেই হতাশ, লঞ্চ বন্ধ। ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ মালিক সবাই ভাড়া বৃদ্ধি করবে কিন্তু আমাদের কী হবে? তেলের দাম বৃদ্ধিতে সব কিছুর দাম বাড়বে। ২০০ টাকার সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া ৬০০ টাকা দিয়ে এলাম, এখন আবার ফেরত যেতে হবে।
সিদ্দিকুর রহমান রাজধানীর গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি জানান, অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়ি বরিশালের কোতোয়ালি থানা এলাকায়। ৫০০ টাকার বিনিময়ে অটোরিকশা করে এসেছেন সদরঘাটে। এখন শোনেন লঞ্চ বন্ধ।
মন্তব্য করুন