সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, মালিক সমিতির দিক থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারির পাশাপাশি গতকাল মঙ্গলবারও বাসে খেয়ালখুশিমতো বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। বাস্তবে 'কঠোর ব্যবস্থা' নিতে দেখা যায়নি কাউকে। জরিমানায় সীমাবদ্ধ ছিল যাবতীয় তৎপরতা। জনবল সংকটে থাকা বিআরটিএর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সামর্থ্য কতটুকু- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকাতে এসব হুঁশিয়ারি লোক দেখানো কিনা, ঘুরেফিরে সে কথাই আসছে আলোচনায়।
সারাদেশের ৪৮ লাখ নিবন্ধিত গাড়ি দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হাতে। আইন মেনে গাড়ি না চললে শাস্তি দিতে ঢাকা মহানগরে ৯ জন এবং চট্টগ্রাম মহানগরে দু'জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন সংস্থাটির। মহানগরের সীমানার বাইরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় কিংবা সড়কের অন্যান্য নিয়ম ভেঙে শাস্তি দিতে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয় তাদের।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, সব জেলার প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে গতকাল চিঠি দিয়েছে বিআরটিএ। ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের দুই দিন পর গতকাল পূর্ণাঙ্গ ভাড়ার তালিকা তৈরি করলেও তা এখনও ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার তালিকা লাগানোর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও গতকাল পর্যন্ত কোনো বাসে তা দেখা যায়নি।
এদিকে গতকালও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ার করে বলেছেন, পুনর্নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে সরকার। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্ধারিত হারে ভাড়া নিতে মালিক-শ্রমিকদের অনুরোধ করেছেন তিনি।
কঠোর হওয়ার এমন বার্তা থাকলেও মামলা ও জরিমানার সংখ্যা গতানুগতিক। গতকাল ঢাকায় আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ২৫৭টি বাসের কাছ থেকে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে বিআরটিএ। এর মধ্যে ৭৩টি বাসকে জরিমানা করা হয়েছে বাড়তি ভাড়া নেওয়ায়। এ হিসাবে ২৮ শতাংশ বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসে দুই হাজার ৩০৪ মামলায় ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। গতকালের জরিমানা, মামলার সংখ্যা বলছে- স্বাভাবিক সময়ের মতোই আইন প্রয়োগের কাজটি চলছে।
তবে বাসে যে ব্যাপক হারে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে- সে কথা বিআরটিএর কর্তাব্যক্তিরাই স্বীকার করেছেন। সংস্থাটির পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. সরওয়ার আলম সমকালকে বলেন, ২৫ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। যে রুটে ১০ টাকা ভাড়া বেড়েছে, সেখানে ২০ টাকা বাড়তি নেওয়া হচ্ছে। নগর পরিবহনে বেশি অনিয়ম হচ্ছে। দূরপাল্লার বাসগুলো নিয়ম মেনেই ভাড়া নিচ্ছে। সুযোগ বুঝে সিএনজিচালিত বাসগুলোও বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
তবে পরিচালক নিজেই বলেছেন, চালক-শ্রমিককে জরিমানা করে ফল হবে না। মালিকের নির্দেশে তারা অতিরিক্ত ভাড়া নেন। ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যে বাসে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হবে, তার মালিককে জরিমানা করতে হবে, যাতে দৃষ্টান্ত তৈরি হয়। বুধবার থেকে বিআরটিএ ওই পথেই যাবে। গতকাল মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত ভাড়া নিলে কিংবা গাড়ির হালনাগাদ কাগজ না থাকলে গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বিআরটিএর। কিন্তু সরাসরি মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির কম। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজার প্রতিবাদে সড়কে বাস রেখে ঢাকা অচল করে দেওয়া হয়েছিল। কর্মকর্তারা জানান, সে কারণে চাইলেও অনেক কিছু করা যায়নি।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সমকালকে বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মঙ্গলবার মালিক-শ্রমিকসহ অংশীজনের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। সেখানে সিএনজিচালিত স্টিকার লাগাতে বলা হয়েছে সংশ্নিষ্ট গাড়ির মালিকদের। চিঠিও দেওয়া হয়েছে তাদের।
সেপ্টেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী, বিআরটিএতে অনুমোদিত ৮২৩টি পদের ১২১টি শূন্য রয়েছে। সংস্থাটির জনবল বাড়িয়ে তিন হাজার ৮২০ জন করার প্রস্তাব করা হয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ৩১৫টি পদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করে। সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয় ৯৬টি পদ বৃদ্ধির অনুমোদন করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের সীমানার বাইরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ম্যাজিস্ট্রেট নেই তাদের।
এসব সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেছেন, ঢাকায় ৯ জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। এত বড় শহরে সীমিত জনবলে আইন প্রয়োগ কঠিন। তবে পুলিশ, জেলা প্রশাসন সবাইকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বুধবার থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে থাকবেন।
তবে খুলনার জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিআরটিএ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিঠি পাননি।
এদিকে, পরিবহন নেতারাও বাড়তি ভাড়া নিলে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আজ থেকে পরিবহন কোম্পানি ও মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা রাস্তায় থাকবেন বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে। তবে অতীতেও ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করা, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা, ট্রাফিক আইন কার্যকরে এমন নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছিল মালিক সমিতি। কিন্তু ফল খুব একটা আসেনি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেছেন, সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা মেনে চলতে মালিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠক করেন মালিক-শ্রমিকরা। সূত্র জানিয়েছে, সেখানে মালিকরা অনুযোগ করেন, সংবাদ মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে খুব নেতিবাচক সমালোচনা হচ্ছে। যতটা বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। মালিকদের জনগণের সামনে 'ভিলেন' বানানো হচ্ছে।
ডিজেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা লিটার হওয়ায় ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে গত শুক্রবার থেকে সারাদেশে বাস চলাচল বন্ধ করে দেন মালিকরা। তিন দিনের দুর্ভোগের ধর্মঘট শেষ হয় গত রোববার বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানোর পর। সোমবার থেকে নতুন ভাড়ায় চলছে বাস।
গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, জিগাতলা থেকে রামপুরা পর্যন্ত তরঙ্গ পরিবহনের ভাড়া ছিল ২০ টাকা। তারা এখন ৩০ টাকা নিচ্ছে। যদিও সরকারি তালিকা অনুযায়ী এ দূরত্বের ভাড়া হবে ১৯ টাকা। আগে ছিল ১৫ টাকা। পাঁচ টাকা বাড়তি ভাড়া তারা আগে থেকেই নিত। এখন বাড়তি নিচ্ছে ১১ টাকা।
একই চিত্র দেখা গেছে সায়েদাবাদ-টঙ্গী রুটের বলাকা বাসে। এই মিনিবাসে কাকরাইল থেকে মহাখালী পর্যন্ত ভাড়া ১১ টাকা থেকে বেড়ে ১৪ টাকা হয়েছে। কিন্তু তারা নিচ্ছে ২০ টাকা। আগে নিত ১৫ টাকা। 'জ' সিরিয়ালে নিবন্ধিত মিনিবাসগুলো বড় বাসের হিসাবে ভাড়া নিচ্ছে।
সিটিং সার্ভিস বন্ধ হতে পারে :এদিকে ঢাকায় আবার 'সিটিং বাস' বন্ধ হতে পারে। আজ বুধবার মালিক সমিতির সংবাদ সম্মেলন থেকে এ ঘোষণা আসতে পারে বলে দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে জানিয়েছে। গতকাল বিআরটিএর সভাতেও সিটিং সার্ভিস বন্ধের বিষয়ে আলোচনা হয়। বলা হয়েছে, আইনে সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। বেশি ভাড়ায় এই বাস আসনের সমানসংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলে। ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিলে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছিল। মধ্যবিত্তের বাহন হিসেবে পরিচিত এই বাস বন্ধের ফলে চরম জনদুর্ভোগ হয়। গাদাগাদি করে বাসে চড়তে গিয়ে নারী ও শিশুদের নাকাল হতে হয়। সে সময় পাঁচ দিনের ভোগান্তির পর সিটিং সার্ভিস চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। তখনই মালিকদের দাবি ছিল, যেহেতু সিটিং সার্ভিস দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয় না, তাই পৃথক ভাড়ার তালিকা করতে হবে, যা সাধারণ লোকাল বাসের চেয়ে বেশি হবে। এ বিষয়ে সুপারিশ করতে ২০১৭ সালে সরকার কমিটি করেছিল। কমিটিও পৃথক ভাড়ায় সিটিং সার্ভিস চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছিল।
এবারও বাস ভাড়া বাড়ানোর সময় মালিকরা সিটিং সার্ভিসের জন্য পৃথক ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়েছিলেন। তা না হওয়ায় বেশি ভাড়া নেওয়া সিটিং বাসকে জরিমানার মুখে পড়তে হচ্ছে। সে কারণেই পৃথক ভাড়া নির্ধারণে চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে সিটিং বাস বন্ধ করতে চান মালিকরা। ফলে রাজপথে আবার নতুন আরেকটি দুর্ভোগ সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।