- বাংলাদেশ
- মোকিম-ঝড়ুর ফাঁসি: আপিল অকার্যকর ঘোষণা
মোকিম-ঝড়ুর ফাঁসি: আপিল অকার্যকর ঘোষণা

জেল আপিল নিষ্পত্তির পর ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার আব্দুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ুর করা নিয়মিত আপিল অকার্যকর ঘোষণা করে নিষ্পত্তি করেছে আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল যাতে না হয়, সে জন্য পূর্ণাঙ্গ রায়ে একটি গাইডলাইন থাকবে বলে জানিয়েছে আদালত।
এদিকে আপিল নিষ্পত্তির আগে এক আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে এমন সংবাদে বিব্রতবোধ করেছেন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সব বিচারপতি। ওই আসামির ফৌজদারি আপিল অকার্যকর করে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে গাইডলাইন দেবেন আদালত। প্রধান বিচারপরতির নেতত্বাধীন আপিল বেঞ্চ এমন নির্দেশনা দেন।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপিল বিভাগে সব আপিল একসঙ্গে শুনানি না হওয়ার অন্যতম কারণ ডিজিটাল না হওয়া। সেদিন আসামির ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে বলেও আপিল বিভাগকে ভুল বোঝানো হয়েছে।
এছাড়া আদালত বলেন, ঝড়ু ও মোকিমের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার দায়, আপিল বিভাগের ওপর আসা বিব্রতকর। ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে সঠিক তথ্য না জেনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করায় ক্ষমা চেয়েছেন আইনজীবী।
এর আগে সোমবার মোকিম ও ঝড়ু নামের দুই আসামির দুটি আপিল আবেদনের একটি নিষ্পত্তি করে রায় কার্যকর করা হলেও অপর আপিল আবেদন ঝুঁলে থাকার পেছনে দায় থাকলে তা আইনজীবীর (আসামিপক্ষের) বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
ওই দিন আপিল বিভাগ মন্তব্য করেন, এ দুই আসামির দুটি আপিল আবেদনের একটি নিষ্পত্তি করে রায় কার্যকর করা হলেও অন্য আপিল আবেদন ঝুলে থাকার পেছনে দায় থাকলে তা আইনজীবীর (আসামিপক্ষের)। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সোমবার এ মন্তব্য করেন। পরে এ বিষয়টি মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকার ৬ নম্বরে রাখা হয় পরবর্তী নির্দেশনার জন্য। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ। অন্যদিকে দুই আসামির আপিল আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. আসিফ হাসান।
সোমবার শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, গণমাধ্যমে এসেছে এখানে নাকি আপিল পেন্ডিং থাকা অবস্থায় আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, আসামিপক্ষ একটা জেল আপিল ফাইল করেছিল। ওই রায়ের সার্টিফাইড কপিও দেখেছি। জেল আপিলে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড ছিলেন আইনজীবী নাহিদ সুলতানা।
তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, এখানে আপিলকারী প্রথমজনের নাম কি? জবাবে অ্যাটর্নি বলেন, ঝড়ু (আসামির নাম)। পরে প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলার পেপারবুক তৈরি হয়েছে কোর্টের মাধ্যমে। ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর শুনানি হয়েছে। পরে ওই দিনই রায় দেওয়া হয়। ১৪ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা হয়েছে। পরে প্রধান বিচারপতি আসামির করা আপিলের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সুফিয়া খাতুনের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি কি এটা জানেন না? যখন জেল আপিল করে তখন একটা আবেদন দিয়ে দুটি একসঙ্গে কনভার্সন করে নিতে হয় যে, আমরা রেগুলার (নিয়মিত) আপিল করছি, আমাদের এটা কনভার্ট করে নেন।
জবাবে সুফিয়া খাতুন বলেন, ক্লায়েন্ট আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। কোনো ফাইল দেয়নি। মামলা যিনি দিয়েছেন, তাকে যথা সময়ে জানিয়েছি। কিন্তু এরপরও সাড়া পাওয়া যায়নি। তখন আইনজীবী মো. রুহুল আমিন তুহিন এ মামলার আইনজীবী বলে আদালতকে জানিয়ে বলেন, দুটি আপিল হলে সেকশনই তো যোগ করে দেয়।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, সেকশন যোগ করে না। আমাদের এখানে তো ডিজিটাল সিস্টেম না। বরং আপিলকারী আইনজীবী এসে বলেন যে, এটা ওইটার সঙ্গে (একটির সঙ্গে অন্যান্য আপিল আবেদন) ট্যাগ করেন। মামলায় মক্কেলদের সঙ্গে যখন যোগাযোগ থাকে তখনই আমরা এলার্ট হই। তখন জেল আপিলে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডে নাহিদ সুলতানা কীভাবে হলেন, তা জানতে চান অ্যাটর্নি জেনারেল।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা হয়তো কোর্ট থেকে নিয়োগ (দুঃস্থ আসামির ক্ষেত্রে) দিয়েছে। তখন সুফিয়া খাতুন বলেন, এটা তাহলে নাহিদ সুলতানারও দায়িত্ব ছিল আপিলের বিষয়টি বলে দেওয়া। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল জেল আপিলে আইনজীবী নাহিদ সুলতানা কী বক্তব্য আদালতে দিয়েছিলেন, সেটা পড়ে শোনান। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী আসিফ হাসান আদালতে যুক্ত হয়ে কথা বলার সুযোগ চান।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ মামলায় আপিল বিভাগে রায় হয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রত্যাখ্যান করেন। আর কারা কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে দেখা করার জন্য চিঠি দিল ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর। চিঠির পর তাদের পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাতও করেছেন। রায় কার্যকর হলো ১৭ নভেম্বর। রায়ের এক বছর পরে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের চিঠি দেয়। এই এক বছর পর্যন্ত আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কিছুই করলেন না। এতটা সময় পেলেন, তারপরও তার কোনো আইনজীবী কিছুই জানাননি।
তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, গত দুই সপ্তাহ আগে আইনজীবী হুমায়ন কবির আমাকে এ মামলায় যুক্ত করেছেন। তিনি এ মামলাটি করে দিতে বলেন। পরে আমি তাকে বললাম আপনি মামলার আসামিদের পরিবারের খোঁজ নেন। আমি একটু পড়ে দেখি। ওই দিন রাতে আইনজীবী হুমায়ন কবির আমাকে জানান, আসামিদের সাজা কার্যকর হয়ে গেছে। হুমায়ন কবির ওই এলাকার বাসিন্দা। তিনি আপিলে অ্যানরোল না থাকায় ২০১৩ সালে আইনজীবী নওয়াব আলীকে দিয়ে ফাইল করেছিলেন। তিনি নেই (মারা গেছেন)।
এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপিল বিভাগে অ্যানরোল না হয়েও যখন অন্য একজনকে দিয়ে মামলা ফাইল করেছেন, তিনি যদি আপিলের পদ্ধতি না জানেন, তখন মহামুশকিলের কথা। তখন আইনজীবী আসিফ বলেন, আমরা যখন আপিল ফাইল করি, তখন অটোমেটিক্যালি ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এটা অর্ডার ২৪ রুলস ৫ এ আছে। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, জেল আপিল তো মেরিটে শুনানি হয়েছে। আইনজীবী বলেন, ঠিক আছে, তবে দুটি (দুটি আপিল) ট্যাগ হওয়া উচিত ছিল।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা যখন আইজীবী ছিলাম, জেল আপিল যখন থাকে আমরা তখন সেটি কনভার্ট করেছি। এই প্র্যাক্টিস তো এখন টোটাল বন্ধ হয়ে গেছে।
আইনজীবী আসিফ বলেন, মাই লর্ড এটা এখনও করছি। তারপরও কষ্ট হচ্ছে মানুষের জন্য কিছু করতে পারলাম না। আমরা দুজন মানুষের জন্য চেষ্টা করতাম। জেল আপিলের আমরা কিছুই পাইনি। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ বলেন, এটা রিপোর্টেড রায়। রায়টি ৫৯ ডিএলআরে আছে।
আইনজীবী আসিফ বলেন, মাই লর্ড এ বিষয়ে একটা গাইডলাইন দিয়ে দেন। সঙ্গে এই গরিবদের জন্য যদি কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়। তখন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, এই ক্ষতিপূরণ কিসের জন্য? বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান বলেন, যে আইনজীবী ভুল করেছেন, তাকে বলেন। তিনি কিছু দিয়ে দিক। এটা তো কথা না। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তখন আইনজীবী আসিফ হাসানের কাছে জানতে চান, জেল কর্তৃপক্ষের দোষটা কোথায়? আপিল বিভাগ থেকে অন ম্যারিটে জাজমেন্ট হয়েছে, সেটা কমিউনিকেশন হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা খারিজ হয়েছে, পরে রায় কার্যকর করা হয়েছে।
আইনজীবী আসিফ হাসান তখন বলেন, আইনগত কোনো ভুল নেই। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তখন বলেন, তাহলে জেল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন কেন? আইনজীবী আসিফ বলেন, এ ধরনের মানুষের জন্য বিষয়টি সামনে আনা উচিত। এরা (আসামিদের পরিবার) অশিক্ষিত, মুর্খ।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, যখন শুনানি হয়েছিল, তখন উচিত ছিল অ্যাপেয়ার করা। আপনারা (আইনজীবী) দোষটা স্বীকার করেন না কেন? পরে আপিল বিভাগ এ বিষয়টি মঙ্গলবারের কার্যতালিকায় ১ নম্বরে ধার্য করেন।
শুনানিতে আদালত বলেন, জেল আপিলের সঙ্গে সঙ্গে আসামিদের আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ার দায় আসামিপক্ষের আইনজীবীদের। তবে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড আইনজীবীরা দাবি করেন, এর দায় সুপ্রিমকোর্টের সেকশনের। আর আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, বিষয়টি নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
গত ৩ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালতে একটি আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে চুয়াডাঙ্গার দুই আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা পরে দেশব্যাপী ব্যাপাক আলোড়িত হয়। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং যশোর কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আইনগত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই আসামি আব্দুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় সাবেক ইউপি সদস্য মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার চাচাতো ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে মোকিম ও ঝড়ুর নাম আসে। পরে ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ মামলার বিচারে তিন জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ, দুই জনকে যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন— একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাকি আসামিদের খালাস দেন হাইকোর্ট।
পরে মোকিম (আপিল নং- ১১১/২০১৩) ও ঝড়ু (আপিল নং- ১০৭/২০১৩) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল (জেল আপিল ও নিয়মিত আপিল) দায়ের করেন। তবে নিয়ম অনুসারে দুটি আপিল একসঙ্গে ট্যাগ না হওয়ায় শুধু জেল আপিল নিষ্পত্তি করে ২০১৭ সালে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রায় ৪ বছর পর অপর মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় উঠলে আপিল নিষ্পত্তির আগেই দুই আসামিকে ফাঁসি দেওয়া নিয়ে আলোচনা ওঠে।
মন্তব্য করুন