১৯৬৯ সাল। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নেমে এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের মিছিলকে স্তব্ধ করে দিতে গুলি চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা। 'ডোন্ট ফায়ার। আই সেইড :ডোন্ট ফায়ার'- ছাত্রদের মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন ড. জোহা। কিন্তু থামল না পাকিস্তানিরা। শহীদ হলেন তিনি তাদের গুলিতে।

শহীদ শামসুজ্জোহার এই আত্মদানের দৃশ্যরূপ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় 'জোহা হল কথা কয়' নাটকটি। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ এই শিক্ষকের নামে গড়ে ওঠা হলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিণত হয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মিনি ক্যান্টনমেন্টে। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন সেখানে ছিল সাধারণ ঘটনা। সেই দিনগুলোই রূপায়িত হয়েছে ৭১ মিনিটের এই নাটকে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির 'গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার' কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি)। এ নাটকে জোহা হলের ছাদ এবং তিনটি ব্লকের দুটিকে নানা আলোকসজ্জার মাধ্যমে মঞ্চে পরিণত করা হয়।

এর আগে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে 'জোহা হল কথা কয়' নাটকের উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক। এই পরিবেশ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক আতাউর রহমান রাজু। সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী জেলা প্রশাসন। নাটকটিতে সম্পৃক্ত ছিলেন ২২১ জন কলাকুশলী।

ড. জোহার আত্মদানের দৃশ্যের পরপরই এ নাটকে দেখা যায়, রাজশাহী শহরে এপ্রিলের দিকে প্রবেশ করছে পাকিস্তানি বাহিনী। টর্চার সেল গড়ে তোলা হয়েছে জোহা হলে। আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে নারী-পুরুষদের। হত্যা-নির্যাতনের নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে পাকিস্তানি সেনারা। এইভাবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে এ নাটকে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ। নাটকের শেষে দর্শক দেখতে পান মা ও তার ছেলের মৃত্যুর আগে আকাশে লাল-সবুজের পতাকা দেখে যাওয়ার আকুতি। আবেগঘন ক্রন্দনে মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকেন তারা, আর হল প্রাঙ্গণে পত পত করে উড়তে থাকে স্বাধীন দেশের পতাকা।

এ ছাড়াও নাটকের বিভিন্ন সময়ে একাত্তরে জোহা হলে নির্যাতনের শিকার তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দর্শক-শ্রোতাদের সামনে তাদের দুঃসহ স্মৃতিগাথা তুলে ধরেন। এ সময় তাদের মঞ্চে 'রাজকীয়' চেয়ারে বসিয়ে সম্মান জানানো হয়।

নাটকের একেবারে শেষে ভেসে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বধ্যভূমি সম্পর্কে এক রুদ্ধ কণ্ঠস্বর :'ওখানে (বধ্যভূমিতে) যারা যায়, তারা কেউ জানে না এই মাটির কান্না। শুনেছি, ওখানে যারা ঘুমিয়ে আছেন, তাদের পরিবারের কেউ খোঁজ রাখে না। কী কষ্ট তাদের! শুনেছি, ওখানে অনেকেই জুতা পায়ে ওঠে বেদিতে। জোহা হলে নেই কোনো স্মৃতি সংগ্রহশালা। চিরচেনা এই জোহা হল যে কত অব্যক্ত কথা কয়!'

নির্দেশক আতাউর রহমান রাজু জানান, নাটকটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় জোহা হলের বারান্দা, ব্যালকনি, রাস্তা এবং আশপাশে যা যা ঘটেছে, তা হুবহু চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সে সময়ের নির্যাতনের চিত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই এ নাটকের আয়োজন।

নাটক চলার সময় প্রদর্শনীস্থলে ছিলেন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া ও অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, নাট্যকার অধ্যাপক মলয় ভৌমিক, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. হুমায়ুন কবির, জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী প্রমুখ। প্রায় চার হাজার দর্শক নাটকটি দেখেছেন।