- বাংলাদেশ
- আবার রক্তক্ষরণ হলে খালেদা জিয়ার মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে
মেডিকেল বোর্ডের সংবাদ সম্মেলন
আবার রক্তক্ষরণ হলে খালেদা জিয়ার মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে

খালেদা জিয়া
অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আবার রক্তক্ষরণ হলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তার মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা। তারা বলেছেন, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ায় তার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ পর্যন্ত তিনবার রক্তক্ষরণ সামাল দেওয়া গেছে। এখন তার যে অবস্থা, তাতে আবার রক্তক্ষরণ হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। তার জীবন হুমকিতে। চিকিৎসকরাও এখন অসহায় বোধ করছেন।
চিকিৎসকরা বলেছেন, বাংলাদেশে এ ধরনের রক্তক্ষরণ সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসকরা তাকে যত দ্রুত সম্ভব দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ সময় তারা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার সুপারিশ করেছেন।
গতকাল রোববার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজায় সংবাদ সম্মেলনে মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা এসব তথ্য জানান। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিকেল বোর্ডের প্রধান এফ এম সিদ্দিকী বিএনপি নেত্রীর রোগ নিয়ে প্রাথমিক বর্ণনা দেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পেট থেকে চাকা চাকা রক্ত বের হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, আপাতত হাসপাতালে রক্ত দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু এ ধরনের রোগীকে বারবার রক্ত দেওয়া সম্ভব নয়। আবার রক্তক্ষরণ হলে তার মৃত্যুঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।
ডা. সিদ্দিকী জানান, ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিনই হঠাৎ তার ম্যাসিভ রক্তবমি হয়। ওই সময় চিকিৎসকরা জীবন বাঁচানোর জন্য আইভি ফ্লুইড দেওয়া শুরু করেন এবং দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করেন। সে সময় দুই ব্যাগ পিআরবিসি এবং আরও দুই ব্যাগ ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা ও আইভি ফ্লুইড দিয়ে পরবর্তী তিন ঘণ্টা ধরে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তখন এন্ডোস্কোপি করে রক্তক্ষরণের জায়গা চিহ্নিত করে তার চিকিৎসা জরুরি ছিল। কিন্তু ওই সময়ে তার প্রেশার ও পালস এত বেশি পড়ে যায় যে, তা সম্ভব হচ্ছিল না। এ সময় পুরো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং মেডিকেল টিম দ্রুত খালেদা জিয়াকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে এসে রাত ৩টার দিকে এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করে।
মেডিকেল বোর্ডের প্রধান বলেন, ওই সময় তার সিরোসিস লিভার রোগে ম্যাসিভ রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য ছয়টি ব্যান্ডিং করা হয়। এর মাধ্যমে কোনোক্রমে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব হয়। তখন চিকিৎসকদের মাথায় রাখতে হয়েছে, তিনি ডায়াবেটিস এবং হার্ট ফেইলিওরের রোগী। খালেদা জিয়ার হিমোগ্লোবিন নেমে ৫ দশমিক ৪ হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকরা সেটাকে চার ব্যাগ রক্ত দিয়ে ৯/১০-এর কাছাকাছি নিয়ে যান। আবার সেটা কমে গিয়েছিল ৭ দশমিক ৮-এ।
তিনি বলেন, 'এটা মনে রাখতে হবে যে তার যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, অনেক রক্ত দিয়ে আপনি হিমোগ্লোবিন বাড়াতে পারবেন না। তাহলে সেটা আবার রিবিল্ড করবে। সেজন্য আইডিয়ালি হিমোগ্লোবিনকে একটা লেভেলের মধ্যে ধরে রাখতে হয়।'
ডা. সিদ্দিকী বলেন, 'খালেদা জিয়ার গুরুতর অবস্থার বিষয়টি আমরা পরিবারকে জানিয়েছি। আপনারা যত দ্রুত পারেন তাকে দেশের বাইরে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ, প্রথম দিনের মতোই আরও তিন দিন তার রক্তক্ষরণ হয়। ১৭ নভেম্বর আবার তার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আমরা লাইফ সেভিং মেডিসিন দিয়ে তাকে কিছুটা স্টেবল করতে সক্ষম হই। ২১ নভেম্বর মনে হলো যে, তার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। পরে ২৪ নভেম্বর তাকে জেনারেল ওটিতে নিয়ে এন্ডোস্কোপি করা হয়। এবার ম্যাসিভ রক্তক্ষরণ আরেকটু নিচ থেকে হচ্ছে বলে মনে হলো। এটার সোর্স পর্যন্ত আমরা যেতে পারিনি। আমরা আবার তাকে লাইভ সেভিং মেডিসিন দিয়েছি, আবার ব্লাড ট্রান্সমিশন করেছি।'
শঙ্কা প্রকাশ করে চিকিৎসকরা বলেন, খালেদা জিয়ার রক্তক্ষরণ আবার হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার যে পরিস্থিতি, তাতে রক্তক্ষরণ হওয়ার ইঙ্গিতই মিলছে। ডায়াবেটিস, লিভারসহ অন্য সমস্যাগুলো নিয়ে এরপর রক্তক্ষরণ হলে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বেন খালেদা জিয়া। বিষয়টি তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ পরিবারকে জানিয়েছেন। তারা আরও বলেন, একটা সময় আসতে পারে তাকে আর স্থানান্তর করাও যাবে না। বিষয়টি সবাইকে জানাতে খালেদা জিয়া অনুমতি দিয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলেন, চার মাস আগে বিদেশ গেলে এই রক্তক্ষরণ হতো না। পরিবারকে ঝুঁকির কথা বলেছি, ভয়ের বিষয়টি চিকিৎসক হিসেবে স্পষ্ট বলতে পারেননি। তার লিভার প্রায় তছনছ হয়ে গেছে। তৃতীয়বার রক্তক্ষরণ অনেক বেশি ছিল। লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
ডা. সিদ্দিকী জানান, 'বিগত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খালেদা জিয়ার রক্তক্ষরণ হয়নি। এখন স্টেবল আছে। এখন টিপস-মেথড প্রয়োগ করা না হলে পুনরায় রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কা আছে। এটা পরবর্তী সপ্তাহে ৫০ ভাগ, পরবর্তী ছয় সপ্তাহে ৬০ ভাগ এবং তার পরও যদি যায়, তাহলে অবশ্যই কিছু ঘটতে যাচ্ছে ধরা যায়। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যা করছি- আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টায়। এখন আমরা হেলপলেস ফিল করছি। এখন এ রকম একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে উনি যাচ্ছেন। তার জন্য পরিস্থিতি লাইফ থ্রেটেনিং।'
বাইরে থেকে চিকিৎসক ও চিকিৎসা পদ্ধতি ঢাকায় এনে করা সম্ভব কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, টিপস টেকনোলজি আছে শুধু যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজে। যুক্তরাজ্যের কোনো রোগীর এ রকম হলে তাকে হেলিকপ্টারে ওই হাসপাতালে পাঠানো হয়। এভাবে একজন রোগীর জন্য একটা হাসপাতালকে ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়।
চিকিৎসকরা আরও বলেন, মঙ্গলবার রাতে তার ব্লাড প্রেশার ছিল ওপরে ৯০, নিচে ৫০-এর মতো। তখন আমরা বুঝতে পারি, তার খাদ্যনালিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তখন বাজে রাত সাড়ে ৯টার মতো। তখন আমরা তাকে বিভিন্ন সাপোর্ট দিতে থাকি। দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করি। তখন তার যে সমস্যাটা ছিল, এতে যে কোনো সময় মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। তাকে ওই সময় তিন ঘণ্টার মতো রক্ত দেওয়াসহ চিকিৎসার সর্বোচ্চটুকু দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এজেডএম জাহিদ হোসেন, ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি অ্যান্ড হেপাটোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. এ কিউ এম মোহসেন, ডা. নুরুদ্দীন আহমদ ও ডা. শামসুল আরেফিন উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন