ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের দুই সংসদ সদস্য (এমপি) লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক ও রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছেন- এ অভিযোগ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিএম তালেব হোসেনের। তার ভাষ্য, এ কারণেই নরসিংদী সদরে কয়েকটি এবং রায়পুরায় বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের ছয়টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। তিনটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা দ্বিতীয় স্থানও পাননি। চাপাইর ইউনিয়নে জয় পাওয়া বিদ্রোহী প্রার্থী সাইফুজ্জামান সেতুর ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাসেল। স্থানীয় পর্যায়ের এই শীর্ষ নেতা তার ভাইকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অন্য বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আনাটা সম্ভব হয়নি- এমন দাবি দলটির উপজেলা নেতাদের। উপজেলাটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নির্বাচনী এলাকা।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা ইউপি নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যান তুলে ধরে সমকালকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আগের চাইতে বেড়েছে। কিন্তু কয়েকজন এমপির বিরূপ অবস্থানের কারণে দলীয়ভাবে ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি বলে দলের প্রাথমিক বিশ্নেষণে মনে করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওতাধীন পাঁচটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপের ওই নির্বাচনে দুটি ইউনিয়নে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এই আসনের এমপি হলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান।
শরীয়তপুর-১ আসনের আওতাধীন চারটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পেলেও পাঁচটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে দলীয় প্রার্থীরা নাকাল হয়েছেন। এই আসনের এমপি দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ইকবাল হোসেন অপু। প্রায় একই দশা হয়েছে মাদারীপুরে। মাদারীপুর-৩ আসনের আওতাধীন ৯টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাজয় হয়েছে। তিনটি ইউনিয়নে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এই আসনের এমপি দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। মাদারীপুরের কালকিনির একটি ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোট পেয়েছেন মাত্র দুটি।
গত ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এই ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে ফল বিপর্যয়ের জন্য সংশ্নিষ্ট এমপিদের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, নরসিংদী-১ আসনের এমপি নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক, নরসিংদী-৫ আসনের এমপি রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু এবং কুমিল্লা-৪ আসনের এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলসহ কয়েকটি জেলার শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থীদের আশকারা দিয়েছেন। মন্ত্রিসভার একজন সদস্য, যিনি দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই মন্ত্রী ময়মনসিংহ বিভাগের আওতাধীন একটি জেলার একটি আসনের এমপি। মন্ত্রিসভার আরও তিনজন সদস্য- যাদের বাড়ি বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে, তাদের বিরুদ্ধেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরোধিতা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রিসভার আরও কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য বলেছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকেই সাংগঠনিক শাস্তি পেয়েছেন। তাদের দল থেকে বহিস্কারও করা হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। কেন্দ্র থেকে দফায় দফায় নির্দেশ দেওয়ার পরেও কয়েকটি জেলার নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বেলায় নিশ্চুপ থেকেছেন। এ ক্ষেত্রে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ আলোচনার পুরোভাগে চলে এসেছে। তা ছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিস্কার করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কয়েকজন এমপি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপক্ষে গিয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ফল বিপর্যয় এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের আশকারা দেওয়া এমপিদের ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দলের কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের স্পষ্ট অভিযোগ, ওই এমপিরা বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইচ্ছুকদের মনোনয়নপত্র কেনার কথা দলের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে। কিন্তু মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রত্যাশায় অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় পর্যায়েও ফরম বিক্রির মতো কাণ্ড হয়েছে।
কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, ইউপি নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের ময়নাতদন্ত চলছে। জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি কমপক্ষে ৫০ জন এমপি ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহী প্রার্থীদের আশকারা দেওয়া নেতাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য সমকালকে জানিয়েছেন, ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের কারণ বিচার-বিশ্নেষণ করছেন দলের আট সাংগঠনিক সম্পাদক। তারা ইতোমধ্যে আটটি সাংগঠনিক বিভাগের প্রাথমিক রিপোর্ট দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে উপস্থাপন করেছেন। আগামী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় পঞ্চম ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, সিলেট বিভাগের ১৬ জন এমপির মধ্যে দুই থেকে তিনজনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীকে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইউপি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়া এমপিদের তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। তার ভাষায়, ইউপি নির্বাচনে আঞ্চলিকতাই বড় ফ্যাক্টর। রাজনীতি খুব একটা কার্যকর নয়। তা ছাড়া বিদ্রোহী হিসেবে বিজয়ীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের।
খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকের দৃষ্টিতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায় থেকে পাঠানো সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় গলদ থাকায় প্রার্থী নির্বাচনে সংকট হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমন্বয়ও ছিল না। তা ছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নেই গড়পড়তা পাঁচজনের বেশি প্রার্থী মনোনয়ন চেয়েছে। সেখানে মনোনয়নে ব্যর্থ প্রার্থীরা এক হয়ে নির্বাচনে লড়েছে। তাদের সমর্থন দিয়েছে বিএনপি ঘরানার শক্তি। তার মতে, খুলনা বিভাগের ৩৪ জন এমপির মধ্যে চার থেকে পাঁচজন এবং স্থানীয় পর্যায়ের কম-বেশি ৩০ জন নেতা বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগের ৫১ জন দলীয় এমপির মধ্যে কমপক্ষে ১১ জনের বিরুদ্ধে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। তিনি বলেছেন, সবকিছুই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের কয়েকজন নেতার পাশাপাশি রাজশাহী বিভাগের ৩১ জন এমপির মধ্যে দুই থেকে তিনজনের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে কয়েকটি ইউনিয়নে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। এই অভিযোগ তদন্তের মাধ্যমে নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার অভিমত, মনোনয়নে ব্যর্থ প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে এক হয়ে যাওয়ায় সংকট বেড়েছে। সেই সঙ্গে বিরোধী দলও সুযোগ বুঝে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় কিছু ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয় পাননি।
ঢাকা বিভাগের ৫৪ জন দলীয় এমপির মধ্যে কমপক্ষে ১৩ জনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, এই বিষয়ে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। কার্যনির্বাহী সংসদের আগামী বৈঠকেও এ ব্যাপারে আলোচনার প্রস্তুতি রয়েছে।
বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, তুলনামূলক বিচারে বরিশাল বিভাগে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভালো করেছে। তবে এই বিভাগের ১৭ জন দলীয় এমপির মধ্যে দুই থেকে তিনজনের ভূমিকা ছিল অনেকটাই নেতিবাচক। তাদের বিরুদ্ধে দল মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে শতভাগ সক্রিয় না থাকার অভিযোগ রয়েছে।
রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিকের মূল্যায়ন, তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিরাজমান অনিয়মই আওয়ামী লীগের ফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, কয়েকটি জেলার প্রভাবশালী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ রংপুর বিভাগের ২৫ জন এমপির মধ্যে ১২ জন বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে।
ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল জানিয়েছেন, তার বিভাগের ৩০ জন এমপির মধ্যে চার থেকে পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগ রয়েছে কয়েকটি জেলার শীর্ষ পর্যায়ের দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। তার ভাষায়, তৃণমূল থেকে পাঠানো তালিকায় অনেক সময় অসংগতি থাকে। ফল বিপর্যয়ের এটিও একটি কারণ। তাই পঞ্চম ধাপের নির্বাচনের জন্য প্রার্থী তালিকা বাছাইয়ের বেলায় নির্মোহ থাকতে তৃণমূল নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিষয় : ইউপি নির্বাচনে ফল বিপর্যয়

মন্তব্য করুন