পায়রাবন্দের যে ভিটেতে রোকেয়ার নাড়ি পোঁতা আছে, তার তোরণের সামনে একটি মসজিদ। তোরণের ভেতরে দখলদারদের নামে করা হয়েছে মাদ্রাসা। ভগ্নস্তূপের মধ্যে টিকে থাকা তোরণের গায়ে সাঁটানো আছে মাদ্রাসার ভর্তি বিজ্ঞপ্তি। সামনে কাপড় শুকানোর জন্য টানানো রয়েছে বাঁশ। কাগজে-কলমে রোকেয়া এবং তার সহোদর ভাইবোনদের এক ছটাক জমিও নেই পূর্বপুরুষের এই পরগনায়। নারী জাগরণের অগ্রদূত এই মহীয়সী নারী জন্মভিটে পায়রাবন্দে আছেন নিছক রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভাস্কর্য হয়ে। নেই এখানকার বেশিরভাগ মানুষের মনেও। তার অবস্থা হয়েছে 'নিজ বাসভূমে পরবাসী'র মতো। বাংলা একাডেমি পরিচালিত স্মৃতিকেন্দ্রে নেই একটি পাঠাগার পর্যন্ত, গবেষণা তো দূরের বিষয়।
সর্বসাধারণ্যে বেগম রোকেয়া নামে পরিচিত মানুষটির নাম ছিল রোকেয়া খাতুন। ইংরেজিতে তিনি সই করতেন Roquiah Khatun নামে। পায়রাবন্দের রোকেয়া খাতুন বিয়ের পর কলকাতায় গিয়ে স্বামীর নাম সঙ্গে জুড়ে পরিচিত হন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলে। নামের আগে-পরে তিনি নিজে কখনও 'বেগম' শব্দটি ব্যবহার করেননি।
ঢাকা থেকে পায়রাবন্দের পথে রওনা দেওয়ার সময় কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীনের সঙ্গে। কয়েক মাস আগে তিনি পায়রাবন্দে এসেছিলেন গবেষণার প্রয়োজনে। সেই সময় একদিন রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে স্থাপিত ভাস্কর্য দেখতে গিয়ে শুনতে পেলেন স্থানীয় এক ব্যক্তি বলছেন, 'রোকেয়া ম্যালাগুলা পাপ করছিল বুঝি! সেই জন্যি মরি যাওয়ার পরও রক্ষা পায় নাই। মূর্তি হয়া ঝড়িত ভেজোছেন, রইদত পোড়া যাওছেন।'
এই যখন রোকেয়ার জন্মভূমির মানুষের কথা, তখন গতকাল বৃহস্পতিবার স্মৃতিকেন্দ্রে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত রোকেয়া স্মরণসভায় সবার ছিল এক কথা- 'বেগম রোকেয়ার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে হবে।' অনেক বছর আগে এর বিপরীতে সমাজের হাল-হকিকত তুলে ধরে 'পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ'-এ চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন লিখেছিলেন- 'নির্মম বাস্তব সত্য হল : পায়রাবন্দেই কোলের শিশু ইসমত আরার বিয়ে হচ্ছে, ৬ বছর বয়সী লাকী শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, আনজেরা আর পাখীরন ধর্ষিতা হচ্ছে কিন্তু বিচার পাচ্ছে না, স্বামীর সম্পত্তির অধিকার-বঞ্চিত হয়েছে হাওয়া বিবি, নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে আছে শুকনীবালা, যৌতুকের কারণে স্বামীর লাঞ্ছনা ভোগ করছে হাজারো নারী। পাশাপাশি রোকেয়ার আঁতুড়ঘরের শেষ থামটিও মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে। পায়রাবন্দের মানুষজন বহু বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন এখানে একটি আবাসিক মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হোক। কখনো দাবি করা হয়েছে মহিলা ক্যাডেট কলেজ নির্মাণের। সরকার এ দাবি কানে তোলেননি। ১৯৯২-এর মার্চে গিয়ে শুনেছিলাম স্থানীয় উৎসাহী কয়েক ব্যক্তি এখানে একটি মহিলা কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু অতগুলো টাকা মিলবে কোথায়? অতএব শুরুতেই ঝিমিয়ে পড়েছে সে উৎসাহ।'
অবশেষে কলেজ হয়েছে। কলেজটির হয়েছে সরকারীকরণও। কলেজের জন্য জমি কেনা হয়েছে দখলদার বলে কথিত রউফ চৌধুরীর উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে। স্মৃতিকেন্দ্রের তিন একর ১৫ শতক জমিও তাদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, 'এ কেনা ও অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে দখলদারদের এক ধরনের বৈধতা দেওয়া হয়েছে।' তিনি জানান, ব্রিটিশ আমলে ১৮৯৯ সালে বেগম রোকেয়া ও তার সহোদর ভাইবোনদের জীবদ্দশায় সিএস রেকর্ড হয়েছিল। ওই রেকর্ডে তাদের কারও নামে পায়রাবন্দে এক ছটাক জমিও রাখা হয়নি। পায়রাবন্দের সব জমি নথিভুক্ত হয়েছিল জমিলা খাতুন ও বাকের সাবের গংয়ের নামে। জমিলা সাবের পরিবারের এক পুত্রবধূ। বাকের সাবের হলেন রোকেয়ার বৈমাত্রেয় ভাই। পরে পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালের আরএস রেকর্ডে জমি নথিভুক্ত হয়ে যায় নূরজাহান বেগমের নামে। তিনি স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি আবদুর রউফ চৌধুরীর স্ত্রী। ওই রেকর্ডে মাত্র ৭২ শতাংশ জমি রোকেয়ার বৈমাত্রেয় ভাই মসিহুজ্জামান সাবেরের নামে নথিভুক্ত হয়েছিল।
রোকেয়ার পিতা জহিরউদ্দিন আবু আলী হায়দর সাবেরের স্ত্রী ছিলেন চারজন। প্রথম স্ত্রী ঢাকার বুনিয়াদী পরিবারের হোসেনউদ্দিন চৌধুরীর কন্যা রাহাতুন্নেসা। তার গর্ভজাত সন্তান পাঁচজন। দুই পুত্র ইব্রাহিম সাবের ও খলিল সাবের; তিন কন্যা করিমুন্নেসা, রোকেয়া ও হোমায়রা। অপর তিন স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন ছয় পুত্র ও তিন কন্যা। তাদেরই একজন মসিহুজ্জামান সাবের চৌধুরী। মসিহুজ্জামান সাবেরের মেয়ে, বেগম রোকেয়া স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক রঞ্জিনা সাবের বলেন, 'আমাদের পূর্বপুরুষের বসতভিটায় জমি ছিল সাড়ে ৩০০ বিঘা। ওই জমির মাত্র ৭২ শতাংশ আমার বাবার নামে রেকর্ড করা হয়েছিল। এর থেকে ৪০ শতাংশ বাবা তার জীবদ্দশায় স্কুলের নামে লিখে দেন। দুই শতাংশ আমি নিজেই লিখে দিয়েছি রোকেয়া স্মৃতি সংসদের পাঠাগারের জন্য। বাকি ৩০ শতাংশ অবশিষ্ট রয়েছে এবং সেটিও ঘিরে রাখা হয়েছে বেগম রোকেয়ার আঁতুড়ঘরের অংশ হিসেবে। প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে জমিটিকে কোনো অধিগ্রহণ ব্যতিরেকে।'
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, 'বেগম রোকেয়ার ভিটেবাড়ি প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন করা হয়েছে। তবে কেউ এখন পর্যন্ত এই জমির মালিকানা দাবি করেননি। এমন কোনো যৌক্তিক দাবি পেলে অবশ্যই অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
ঢাকা থেকে ৩২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পায়রাবন্দ একদা ছিল পরগনা। রংপুর শহর থেকে দক্ষিণে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের ১৩ কিলোমিটারের মতো পথ শেষে দেখা যাবে একটি তোরণ, যার গায়ে লেখা রয়েছে বেগম রোকেয়ার স্মৃতিবিজড়িত পায়রাবন্দ। দিকচিহ্ন দেখানো তোরণ থেকে আরও প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্বদিকে এলেই দেখতে পাওয়া যায় রোকেয়ার গ্রাম খোর্দ মুরাদপুরের। সাধারণভাবে বেগম রোকেয়ার জন্ম পায়রাবন্দ গ্রামে বলা হলেও অতীতের এই পায়রাবন্দ পরগনা ও হালের পায়রাবন্দ ইউনিয়নে রোকেয়াদের জমিজমা সব বেদখল হয়েছে। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনদের বেহাত হয়ে যাওয়া জমি পুনরুদ্ধারের একটি রুল হাইকোর্টের বিবেচনাধীন রয়েছে। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে ২০১২ সালে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ রিট করেন রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র দখল করে গার্মেন্টস কর্মীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালুর বিরুদ্ধে। তিনি জানান, হাইকোর্টের নির্দেশে তখনই গার্মেন্টসের ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অপসারণ করা হয়েছিল। ওই রিটে তারা বেগম রোকেয়ার পৈতৃক জমিজমা উদ্ধারের জন্য একটি রুল চেয়েছিলেন। আশা করছেন, দ্রুতই রায় পাবেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন মিঠাপুকুর (রংপুর) প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান]


বিষয় : বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য

মন্তব্য করুন