আওয়ামী লীগের কৌশলে রাজি নয় জাপা
.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০০:৫৩ | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৬:৩৪
বিএনপিবিহীন নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগ চায় সমঝোতা করে ভোটের মাঠে নৌকা এবং লাঙ্গল; উভয় প্রতীকের প্রার্থী থাকবেন। কিছু আসনে লাঙ্গলকে জেতানো হবে। তবে ক্ষমতাসীনদের এই কৌশলে একমত নয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। জয়ের বিষয়ে আগাম নিশ্চয়তা চায় দলটি। তারা চায়, যেসব আসন লাঙ্গলকে ছাড়া হবে, সেখানে নৌকার প্রার্থী থাকবেন না। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে ৬০-এর বেশি আসনের তালিকা দেওয়া হয়েছে।
দুই দলের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে দল দুটির প্রকাশ্য দাবি, বৈঠক হলেও আসন সমঝোতার কথা হয়নি। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, জাপার সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয় জানি না। আসন ভাগাভাগির আলোচনাও হয়নি। রাজনৈতিক আলোচনা করেছি।
একই দিনে জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, আসন বণ্টনের কথা বলার প্রয়োজনও নেই। নির্বাচন কীভাবে শান্তিপূর্ণ করা যায়, ভোটাররা যেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে আওয়ামী লীগ আলোচনায় ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে।
গত বুধবার রাতে গুলশানের একটি বাড়িতে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ ও জাপার জ্যেষ্ঠ নেতারা। কিন্তু বৈঠকের স্থান এবং আলোচ্যসূচি গোপন রাখা হয়। লুকোচুরি কেন– এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এত ঢাকঢোল পেটানোর কী আছে? নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকা দরকার।’ মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘বিভ্রান্তিকর খবর এড়াতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের সময় ও স্থান গোপন করেছি।’
গতকাল দুপুরে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের গুলশানের বাসভবনে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। এতে জাপার কো-চেয়ারম্যানরা অংশ নেন। আগের রাতেও তারা বৈঠক করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের জানান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং মুজিবুল হক চুন্নু।
এ দুই বৈঠকের সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের কাছে ৬০-এর বেশি আসন চেয়ে তালিকা দেওয়া হয়েছে। আরেকটি সূত্রের দাবি, ৭৫টি আসনের তালিকা দেওয়া হয়েছে। তালিকা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন বৈঠকে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা। কয়টি আসন দেওয়া হবে, তা না বললেও তারা জাতীয় পার্টির তালিকা এবং নির্বাচনী কৌশল-সংক্রান্ত প্রস্তাবের কাগজ নিয়েছেন।
এ দুই সূত্রই জানিয়েছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ থাকায় আওয়ামী লীগ চায়, বিএনপিবিহীন ভোট যেন একতরফা না হয়। সে কারণে প্রার্থিতা বৈধ হওয়া সাপেক্ষে সব আসনে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লাঙ্গলকে মাঠে চায়। যেসব আসন জাতীয় পার্টিকে ছাড়া হবে, সেখানে নৌকার প্রার্থী থাকলেও লাঙ্গলকে জেতাতে সহযোগিতা করা হবে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনী সমঝোতার সিদ্ধান্ত হলেও আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের কৌশলে রাজি নয় জাপা। দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে তা নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেছেন, ‘ম্যাচ ফিক্সিং’-এও পরাজয়ের ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগ ঢাকা থেকে নির্দেশ দিলেও নৌকার প্রার্থীরা ভোটের মাঠে ছাড় দেবেন– তা বিশ্বাস করেন না লাঙ্গলের প্রার্থীরা। তাদের আশঙ্কা, সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক শক্তি এবং ভোট ব্যাংক থাকায় নৌকার কোনো প্রার্থী হারতে রাজি হবেন না। জাপা নেতারা ২০১৮ সালের নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, সেবারও একই পরিস্থিতি হওয়ায় বিব্রতকর ফলাফল হয়েছে। নৌকা এবং আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের না সরালে জিততে পারবে না লাঙ্গল।
সাংগঠনিক শক্তি এবং ভোটের অঙ্কে জাপা ধিরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। দলটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃতীয় স্থানেও থাকতে পারছে না। জাপার একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার মূল্যায়ন, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দুই-তিনটির বেশি আসনে জিততে পারবে না লাঙ্গল। তাহলে জাপা কীসের ভিত্তিতে ৬০-এর বেশি আসন চেয়েছে– এ প্রশ্নে দলটির জ্যেষ্ঠ এক নেতা জানিয়েছেন, বৃহত্তর রংপুরের ২২টি আসনে লাঙ্গলের ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত ভোট রয়েছে। এর বাইরেও অন্তত ৪০টি আসনে ১৫ থেকে ৩০ হাজার ভোট আছে। এসব আসন চায় জাপা।
জাপার দলীয় বৈঠকের সূত্র জানায়, অন্তত ৩৫ থেকে ৩৮ আসনে ছাড় পাওয়ার প্রত্যাশা করছে দলটি। এর মধ্যে ১০-১২টি আসন বৃহত্তর রংপুরের। কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমের মতো দলগুলো বিএনপি থেকে নেতা ভাগিয়ে নির্বাচনে আনতে না পারায় আগামী সংসদে বিরোধী দল হিসেবে জাপা ছাড়া বিকল্প নেই আওয়ামী লীগের। দলটির ১০-১২টির বেশি আসন ছাড়ার ইচ্ছা না থাকলেও জাপাকে সম্মানজনক সংখ্যায় আসন দিতে বাধ্য হবে। নির্বাচনী খরচসহ দল চালাতে যেসব নেতাকে এমপি বানানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তাদের সংসদে নিতে ৩৫ থেকে ৩৮টি আসন চায় জাপা। এসব আসন থেকে নৌকার প্রার্থী না সরালে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার মতো চরম সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জাপায় গুঞ্জন রয়েছে।
জাপার কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আবারও বৈঠক হবে।
২০০৮ সালে জাপাকে ২৯ আসন ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ছেড়েছিল ৪২ আসন। গতবার ছাড় দিয়েছিল ২৭ আসনে। তবে মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, এবার আর আসন বণ্টনের প্রয়োজন নেই। ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে পারলে ১৯৯১ সালের মতো নীরব বিপ্লবও হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস আওয়ামী লীগ দিলেও তা নিয়ে সংশয় রয়েছে চুন্নুর। তিনি বলেছেন, ‘গত পাঁচ বছরে উপনির্বাচন থেকে শুরু করে কোনো ভোটেই জাপার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এ জন্য একটা দ্বিধা এখনও রয়ে গেছে।’ নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টি সরে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে কিনা– এ প্রশ্নে দলের মহাসচিব বলেছেন, ‘বর্জনের ইতিহাস আমাদের কম। তবে যদি এমন নির্বাচন হয়, যাতে কোনোভাবে অংশগ্রহণ করা যাবে না, সেটা অন্য কথা।’
- বিষয় :
- আওয়ামী লীগ
- জাতীয় সংসদ নির্বাচন
- জাপা