দেশে ঠকাচ্ছে দালাল, বিদেশে নিয়োগকারী
.
রাজীব আহাম্মদ
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০১:০০ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৬:১৩
চাকরি নিশ্চিত হলে বিদেশে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয় সরকার। কত টাকা ব্যয়ে, বিদেশের কোন প্রতিষ্ঠানে, কত বেতনে, কী কী সুবিধা ও শর্তে বাংলাদেশি কর্মী চাকরি করতে যাচ্ছেন– প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ অনুমতিতে তা লেখা থাকে স্পষ্ট করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নির্ধারিত ব্যয়ের কয়েক গুণ বেশি টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে কর্মীরা চাকরি পাচ্ছেন না। বিদেশে পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মীকে বিমানে উঠিয়েই আর দায়িত্ব নিচ্ছে না। প্রবাসে মানবেতর জীবনযাপন করে তাঁকে দেশে ফিরতে হচ্ছে শূন্য হাতে। সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের কয়েক গুণ বেশি টাকা নিয়ে ভালো চাকরি ও বেতনের প্রলোভনে বিদেশে পাঠিয়ে এই কর্মীদের দেশে ঠকাচ্ছে দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সি। আর কাজ না থাকলেও ‘ভিসা বিক্রি করে’ কর্মীদের বিদেশ নিয়ে ঠকাচ্ছে নিয়োগকারী কোম্পানি। এতে যোগসাজশ রয়েছে দেশের দালাল এবং বিদেশের কোম্পানির।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে জাতীয় প্রবাসী দিবস। ২০২২ সাল থেকে দিবসটি সরকারের অনুমোদন পেলেও এবারই প্রথম পালিত হচ্ছে জাতীয়ভাবে। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধাখ্যাত বিদেশে থাকা কর্মীরা। তাদের গুরুত্ব দিতেই এ বছর থেকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালনের পরিবর্তে প্রবাসী দিবসে জোর দিয়েছে সরকার। তবে নির্বাচনের কারণে এবারও আয়োজন কম। আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মাননা দেওয়া হবে প্রবাসী সিআইপিদের। হবে আলোচনা সভা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরে রেকর্ড সংখ্যক কর্মী বিদেশ গেছেন। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখ ৯২ হাজার ৭৭৩ জন চাকরি নিয়ে বিদেশ গেছেন। তাদের মধ্যে কত কর্মী ফেরত এসেছেন বা চাকরি না পেয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন– এ তথ্য নেই সরকারের কাছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৫ শতাংশ কর্মী দেশে ফিরতে বাধ্য হন।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্যানুযায়ী, ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আউট পাস নিয়ে ফিরেছেন ৮৪ হাজার ৪০২ জন। অর্থাৎ, তারা কাজ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পাসপোর্ট ছাড়া ফিরেছেন। দেশে আসতে ব্যবহার করেছেন দূতাবাস থেকে নেওয়া আউট পাস। তবে তাদের সবাই চলতি বছর বিদেশ যাননি। অনেকেই গেছেন গত কয়েক বছরে। জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আউট পাস নিয়ে ফেরা কর্মীর কয়েক গুণ ফিরেছেন পাসপোর্ট নিয়ে।
জনশক্তি খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, কর্মী পাঠাতে পারলেই লাভ। এ কারণেই চাকরি নিশ্চিত না করে কর্মী পাঠানো হয়। এতে লাভবান হন কর্মী পাঠানো এবং গ্রহণ করা দেশের ব্যবসায়ীরা। মালয়েশিয়ার উদাহরণ দিয়ে একজন ব্যবসায়ী জানান, শুধু বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে সেখানে ভুয়া কোম্পানি খোলা হয়েছে। মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীর টাকা দিয়ে কর্মী নেওয়ার কথা। কিন্তু প্রতি কর্মী নিয়োগে তারাই উল্টো নিচ্ছে ৫ হাজার রিঙ্গিত বা সোয়া ১ লাখ টাকা। অথচ মালয়েশিয়া যেতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। বাংলাদেশি যে ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সি লটারির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র পায়, তা আবার ‘বিক্রি’ হয়। এতে কর্মীপ্রতি ২০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয় লটারি পাওয়া এজেন্সি। এভাবে ধাপে ধাপে লেনদেনে কর্মীপ্রতি খরচ দাঁড়ায় বিমান ভাড়াসহ ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। এই লেনদেনের কারণেই কাজ না থাকলেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া হয়। বাংলাদেশিদের মধ্যে যে কোনোভাবে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তা কাজে লাগাচ্ছে জনশক্তি ব্যবসায়ী ও দালালরা। দেশে বর্তমানে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা ২ হাজার ১৩৬টি। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার কর্মী পাঠানোর অনুমোদন রয়েছে ১০০টির।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিদায়ী সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মনিরুছ সালেহীন সমকালকে বলেন, না বুঝে যে কোনো মূল্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাই মূল সমস্যা। এ প্রবণতাকেই কাজে লাগায় নিয়োগকারী ও প্রেরণকারী দেশের ব্যবসায়ীরা।
গত ২৪ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার জোহর বাহরু প্রদেশের কোটা টিংগি জেলা থেকে ১ হাজার ৭১০ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে দেশটির পুলিশ। অথচ তারা সবাই বৈধ ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। যাওয়ার পর নিয়োগকারী কাজ দেননি, যোগাযোগও বন্ধ করে দেন। তাদের একজন আশরাফুল আলম। তিনি জানান, মাসে ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত বেতনে কারখানায় চাকরির প্রতিশ্রুতিতে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় মালয়েশিয়ায় যান গত সেপ্টেম্বরে। কিন্তু তাঁকে চাকরি না দিয়ে কিছুদিন একটি বাড়িতে রাখা হয়। এর পর ‘কোম্পানির’ লোকজন ফেলে চলে যায়।
আদৌ চাকরি ও বেতনের নিশ্চয়তা আছে কিনা এবং কর্মপরিবেশ কেমন, তা দেখে কর্মীর চাহিদাপত্র সত্যায়িত করার কথা সংশ্লিষ্ট দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর। যাতে কর্মী বিদেশ গিয়ে প্রতারিত না হন। মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, লাখ লাখ কর্মী নিয়োগ হচ্ছে। তবে সরেজমিন পাঁচ শতাংশের বেশি চাহিদাপত্র যাচাই করা সম্ভব নয়।
তিন বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব, মালয়েশিয়া এবং ওমান থেকে কর্মী ফেরত আসার ঘটনা বেশি। চলতি বছরে এই তিন দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী চাকরি নিয়ে গেছেন। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সৌদিতে চাকরি নিয়ে গেছেন ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০২ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মালয়েশিয়ায় গেছেন ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ জন। ওমানে গেছেন ১ লাখ ২৫ হাজার ৯৬১ কর্মী।
বিদেশে গিয়ে চাকরি না পাওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ওমান। এ কারণে দেশটি গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ করেছে। ঢাকায় ওমান দূতাবাস জানিয়েছে, দেশটিতে যত বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন, সেই তুলনায় কর্মসংস্থান নেই। যারা নতুন করে যাচ্ছেন, তাদের চাকরি নিশ্চিত নয়। ফলে বেকার থাকতে হচ্ছে অথবা স্বল্প মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে।
অথচ ওমানে চলতি বছরে মাসে গড়ে ১১ হাজার কর্মী পাঠিয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। সেই কর্মীদের একজন ময়মনসিংহের তারাকান্দার ইস্রাফিল আলী। প্রতিশ্রুত চাকরি না পাওয়ার কথা ফেসবুক গ্রুপে লেখেন তিনি। ইস্রাফিল জানান, ৪ লাখ টাকা খরচ করে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ওমান যান। প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশি টাকায় মাসে ৪৫ হাজার টাকা বেতনে কাঠমিস্ত্রির কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু ওমান গিয়ে প্রথম দুই মাস কাজ পাননি, বেকার ছিলেন। পরে বাংলাদেশিদের ধরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ পেয়েছেন। বাংলাদেশি ২৫-২৬ হাজার টাকার সমপরিমাণ বেতন পাচ্ছেন।
ফেসবুকের গ্রুপগুলোতে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব প্রবাসীদের এমন হাজারো অভিজ্ঞতার গল্প রয়েছে। রামরুর গবেষণা অনুযায়ী, সৌদি আরবে প্রতি মাসে যত কর্মী যান, এর বিপরীতে ১৪ শতাংশ দেশে ফেরত আসেন। এক বছরের মধ্যে ফেরেন ৪৯ শতাংশ কর্মী।
অভিবাসী উন্নয়ন কর্মসূচির (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক শাকিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তিন মাস অবস্থানের জন্য ভিসায় কর্মী নেওয়া হয়। এর পর কাজের অনুমতি হয়। তা কাজে লাগিয়ে চাকরি নিশ্চিত করে রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠাচ্ছে। সেই কর্মীকে মানবেতর পরিবেশে রাখে তারা। কর্মী নতুন কোম্পানিতে কাজ না পেলে ফের ভিসা নবায়ন করতে হয়। এতে বাড়তি টাকা লাগে। ফলে কর্মী পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এর মাধ্যমে আরেকজন কর্মী নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
সৌদি আরবের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ অনুমতি অনুযায়ী, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আরও কম। চেক, ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে এই টাকা নিতে পারবে রিক্রুটিং এজেন্সি। যার প্রমাণ বিএমইটিতে দিতে হবে। কিন্তু নেওয়া হয় কয়েকগুণ টাকা। গত ৫ নভেম্বর অনুমোদিত এভিয়েট ইন্টারন্যাশনাল নামের রিক্রুটিং এজেন্সির ৩০ কর্মীর নিয়োগ অনুমতিতে অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করা ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এতে লেখা রয়েছে, সৌদি আরবের নিয়োগকারীর কোম্পানিতে অবশ্যই চাকরি এবং নির্ধারিত ১ হাজার রিয়াল বেতন পাবেন, এই নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তি সই করতে হবে। সমকালকে একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই কর্মীদের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
৪ লাখ টাকা খরচ করে গত ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে যাওয়া কুমিল্লার লাকসামের মোহাম্মদ বাতেন জানান, তাঁকে প্লাস্টিক কারখানায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে মরুভূমিতে একটি বাড়িতে নিয়ে ফেলে রাখা হয়। এর মধ্যে তিন মাস মেয়াদি ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। কাজ না পেয়ে ১৪ দিন জেল খেটে গত আগস্টে দেশে ফেরেন বাতেন।
রিক্রুটিং এজেন্সির সংগঠন বায়রা সভাপতি আবুল বাশার বলেন, আগে কাগুজে কোম্পানি খুলে কর্মী নেওয়া হতো ভিসা বিক্রি করতে। এখন এ সমস্যা অনেকটাই কমেছে।