খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু
আয়ানের পরিবারের বুকফাটা আর্তনাদ

আয়ান
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ০০:৩৩
ছোট্ট শিশু আয়ানকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল খতনা করতে, কিন্তু কে জানতো, তাঁর আর বাড়িই ফেরা হবে না। ছোট্ট এই অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণটাই খোয়াতে হয়েছে তাকে। পরিবারের বড় সন্তানকে হারিয়ে এখন বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন আয়ানের মা রাত্না বেগম। আহাজারি করছেন আর বলছেন, ‘আই আল্লাহ এ কী হলো, চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে আমার ছোট সন্তানের জীবন দিতে হলো।’ সন্তান হারানোর শোকে পাগলপ্রায় স্বজনরাও। ছোট অস্ত্রোপচার শেষে পাঁচ বছরের আয়ানের বাড়ি ফেরাটা এমন হবে কল্পনাও করতে পারেনি তারা। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে শিশুটির পরিবারের সদস্যদের কান্না আর বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস।
গত ৩১ ডিসেম্বর আয়ানকে ফুল অ্যানেসথেসিয়া (জেনারেল) দিয়ে খতনা করায় বাড্ডার সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল হাসপাতাল। অস্ত্রোপচারের কয়েক ঘণ্টা পরও জ্ঞান না ফেরায় সেখান থেকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠানো হয় শিশুটিকে। সেখানে সাত দিন পিআইসিইউতে (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) লাইফ সাপোর্টে রাখার পর রোববার রাত ১২টার দিকে আয়ানকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। গতকাল সকালে লাশ নেওয়া হয় মর্গে। ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর আড়াইটায় মরদেহ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের কাছে। বাদ আসর নিজ বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে লাশটি দাফন করা হয়। শিশুটি রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের নার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ বলেন, চিকিৎসকদের অবহেলা ও অপচিকিৎসায় আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। মৃত্যুর পর হাসপাতাল থেকে শুধু জানানো হয়েছে আয়ান মারা গেছে। এখনও বিস্তারিত কিছু বলেনি। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় মামলা করেছি। খতনার সময় অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার ৩০ মিনিট পর জ্ঞান ফেরার কথা জানিয়েছিলেন দায়িত্বরত চিকিৎসক। কিন্তু ওষুধ প্রয়োগে ভুল করায় এমন সর্বনাশ হলো। এমনকি অভিভাবকদের না জানিয়ে অপারেশন টেবিলে আয়ানকে রেখে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ঘণ্টাব্যাপী ক্লাস নেওয়া হয়।
শামীম আহমেদের সহকর্মী হাবিবুর রহমান বলেন, খতনার আগের দিনও আয়ানের সব রকমের দরকারি পরীক্ষা করা হয়েছিল। আমরা সব বিষয়ে ডাক্তারদের ওপর আস্থা রেখেছিলাম, কিন্তু তাদের অপচিকিৎসায় আমাদের সন্তান মারা গেল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, অজ্ঞান করতে ঘুমের যে ওষুধ দেওয়া হয় তাতে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ কারণে হার্ট বন্ধ হয়ে যায়, তাৎক্ষণিকভাবে ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে সেটি হয়েছে কিনা দেখতে হবে। এ সময় তিনি শিশুদের অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগে চিকিৎসকদের আরও সতর্ক হওয়ার অনুরোধ করেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফুল হক বলেন, ‘আয়ান আমাদের হাসপাতালে আসার পর তাকে পিআইসিইউতে ভর্তি করা হয় এবং তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। আমরা আমাদের প্রটোকল অনুযায়ী রোগীর পরিবারকে নিয়মিত কাউন্সেলিং করি। রোববার বিকেলে আয়ানের অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং রাত ১১টা ২০ মিনিটে সে মারা যায়।’
ইউনাইটেড গ্রুপের একটি মেডিকেল কলেজ হচ্ছে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ। সেখানে চিকিৎসায় সম্ভাব্য অবহেলার বিষয়ে জানতে চাইলে আরিফুল বলেন, আয়ানের চিকিৎসার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত ১ জানুয়ারি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে একটি বৈঠক করেছে। আমরা আশা করছি, দশ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। এরপরই নিশ্চিত হতে পারব কোনো ভুল চিকিৎসা হয়েছে কিনা। এ ছাড়া অ্যানেসথেসিয়া ও অস্ত্রোপচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত চিকিৎসকরা তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।
এদিকে আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের গাফিলতির অভিযোগ তদন্তে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কমিটির নেতৃত্ব দেবেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান।