দু’দিনের গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপির

ফাইল ছবি
কামরুল হাসান
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ০০:৫৭ | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৪:৪৫
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘একতরফা’ ও ‘ডামি নির্বাচন’ আখ্যায়িত করে বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখবে বিএনপি। সরকারকে ‘অবৈধ’ দাবি করে দ্রুত পদত্যাগ ও অবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে দেশ-বিদেশে জনমত গড়ে তুলবে দলটি। শুরুতে শান্তিপূর্ণ গণসংযোগ, সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করবে তারা। পরে সময় ও সুযোগমতো আবারও রাজপথের কঠোর আন্দোলন দিয়ে সরকারকে ‘চাপে ফেলার’ পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়নের আগে কারাবন্দি হাজার হাজার নেতাকর্মীর মুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন দলের হাইকমান্ড। একই সময়ে নির্বাচনকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির নির্বাচন দাবি করে নানা অসংগতি তুলে ধরে দেশ-বিদেশে সমর্থন আদায়েরও তাদের চেষ্টা থাকবে। এ জন্য বাড়ানো হবে বহুমাত্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা। সবকিছু ঠিক করে নতুন মাত্রায় আবারও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।
এদিকে ৭ জানুয়ারি ভোট বর্জনের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলটি বলেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। ‘একতরফা’ নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তা অবৈধ-অগণতান্ত্রিক। এ সময়ে দেশে গণতন্ত্র আর ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। এ আন্দোলনে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করতে দু’দিনের গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার ও কাল বুধবার সারাদেশে ‘ডামি’ নির্বাচনের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে লিফলেট বিতরণ করবে বিএনপি।
নির্বাচনের পরদিন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় দলটি। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এখানে কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির অপর দুই সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমান।
ড. মঈন খান বলেন, একদলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, তা আবারও প্রমাণ হয়েছে। সরকার ধারাবাহিকভাবে ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা কেড়ে নিয়েছে। ভোট বর্জন করে জনগণ প্রমাণ করেছে, এই সরকার ও তাদের নির্বাচন কমিশন ভুয়া। এ নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারকে বলা যায়– ‘অব দ্য ডামি, বাই দ্য ডামি, ফর দ্য ডামি’।
বিএনপি সূত্র জানায়, নির্বাচনের দিন রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় নির্বাচনের সব দিক নিয়ে আলোচনা করেন নেতারা। সেখানে নেতাকর্মী ছাড়াও তাদের চলমান আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে বিভিন্ন কৌশল নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। এর আলোকে আজ মঙ্গলবার ও বুধবার দু’দিনের গণসংযোগের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এই কর্মসূচিতে সারাদেশে সাধারণ মানুষকে আরও সংঘবদ্ধ করতে, জনমত তৈরি করতে লিফলেট বিতরণ করা হবে।
লিফলেটের শুরুতেই ভোটারদের ভোট বর্জনে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘আপনি ফ্যাসিবাদী সরকারের সাজানো, পাতানো, ভাগবাটোয়ারার নির্বাচন সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ৭ জানুয়ারি সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি সফল করেছেন। অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সফলভাবে অসহযোগ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। এ জন্য আপনাকে অভিনন্দন।’
ড. আবদুল মঈন খান সমকালকে বলেন, এ দেশের মানুষ তাদের নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে। যত দিন না সত্যিকার অর্থে জনগণের অধিকার জনগণের হাতে তুলে দিতে পারবেন– তত দিন তাদের এই আন্দোলন চলবে। এটাই বিএনপির প্রতিজ্ঞা।
বিএনপি নেতারা জানান, ‘একতরফা’ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তাদের কোনো শঙ্কা ছিলো না। তবে ভোটারদের টানার জন্য সরকার যেসব কৌশল নিয়েছিল, সেখানে বিএনপির ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন ও ভোট বর্জনের কর্মসূচি শতভাগ সফল হয়েছে। ভোটাররা ভোট দিতে যায়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকেরও অনেকে এই পাতানো নির্বাচন বয়কট করেছেন। এখন নির্বাচন কমিশন যে ফল ঘোষণা করেছে, সেটাও ‘ডামি’। সারাবিশ্ব এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ এই নির্বাচনকে এরই মধ্যে বিতর্কিত বলে আখ্যায়িত করছে।
দলটির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ জোর করে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসতে পারলেও খুব সহজে তারা হাল ছাড়ছেন না। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে, বাঁচার তাগিদে আন্দোলনকে চূড়ান্ত সফলতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন তারা। বিভিন্ন সেক্টর অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতা। নিয়মিত ভার্চুয়াল বৈঠক করছেন। সেখানে জেলা ও তৃণমূল নেতারা আন্দোলনকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পরামর্শ দিচ্ছেন।
জানা গেছে, ওই সব বৈঠকে টানা দুই মাসের আন্দোলনে নানা সমস্যার কথাও তুলে ধরছেন জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারা। সফলতা, ব্যর্থতার পাশাপাশি দায়িত্বশীল নেতাদের অসহযোগিতা, আত্মগোপনে চলে যাওয়ার বিষয়গুলো সামনে আনছেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ব্যর্থ কমিটির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার গুঞ্জনও রয়েছে দলটিতে।
দলের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য জানান, এখন যা কিছু ঘটবে, তা অতিদ্রুত ঘটতে থাকবে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বের মতামত-পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে ভুয়া নির্বাচন করায় এই সরকার তাদের রোষানলে পড়তে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতিরও প্রভাব পড়তে পারে। আসতে পারে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা। এর মধ্যে গার্মেন্ট শিল্পসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা এলে দেশের অর্থনীতি যেমন পঙ্গু হয়ে যাবে, তেমনি সাধারণ মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে।
বিএনপির ওই শীর্ষ নেতা আরও জানান, সরকারের ওপর বৈদেশিক ঋণের বোঝা রয়েছে। আগামী কয়েক মাসে ঋণের কিস্তি দেওয়া শুরু হলে টান পড়বে দেশের রিজার্ভে। এতে তলানিতে থাকা রিজার্ভ আরও কমবে। সবকিছু মিলিয়ে হিমশিম খাবে সরকার। আর এ সময় থেকে বিএনপিসহ অন্যান্য সমমনা দল ও জোটের নেতাকর্মী নতুনরূপে আন্দোলন গড়ে তুলবে।
বিএনপি নেতারা জানান, এবারের আন্দোলনকে সফল করতে কোমর শক্ত করেই তারা মাঠে নামবেন। ডান, বাম আর ইসলামী দলগুলোর সম্মিলন ঘটানোর টার্গেট রয়েছে। এর বাইরে ভারতবিরোধী অবস্থানকে দলীয়ভাবে পাকাপোক্ত করে দেশের জনগণের আকুণ্ঠ সমর্থন আদায়ের ঘোষণাও থাকবে। ভারতের বর্তমান সরকার কখনও বিএনপিকে ভালোভাবে নেবে না কিংবা ক্ষমতায় আসতে দিতে চাইবে না। সে ক্ষেত্রে বিএনপি প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, সেই নীতিতে আবারও ফিরে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতারা নির্বাচন নিয়ে দেশটির সংশ্লিষ্টতার সমালোচনা করতে শুরু করেছেন। যদিও এক মঞ্চে আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম কিংবা ভারত ইস্যুতে দলের কোনো সিনিয়র নেতা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে এটা বলছেন, এবারে তাদের হারানোর কিছু নেই। অন্দোলন করলেও বিপদ, হামলা-মামলা-জেল অবধারিত; আর না করলেও একই অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের প্রতি দায় থেকে আন্দোলনকেই তারা বেছে নিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন নেতারা
সংবাদ সম্মেলনে ড. মঈন খান বলেন, কোনো নির্বাচন হয়নি। ডামি নির্বাচন কমিশন, ডামি প্রার্থী, ডামি ভোটার এবং সর্বশেষ ডামি অবজারভার নিয়ে একটা নাটক হয়েছে। তাদের যে নির্বাচনী অবজারভার, যাদের ভাড়া করে এনেছিল, তাদের মধ্যে একজন বিদেশি অবজারভার নিজেই বলেছেন, এটি কোনো নির্বাচন নয়। ক্ষমতাসীনরা ডামি প্রার্থী দিয়ে কৃত্রিম প্রতিযোগিতা করেও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিতে পারেনি। ভোটারশূন্য ভোটকেন্দ্রে ডামি ভোটারদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, সরকারের এই নাটকের প্রতি জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মারামারি করেছে, খুনাখুনিও হয়েছে। একটা বা চারটা ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে, এটি হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই না।
ভাড়াটিয়া অবজারভারও বলেছে ভোট হয়নি উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং যে পরিমাণ ভোটের উপস্থিতি দেখানো হচ্ছে, সেটিও ভুয়া। সরকারের ভাড়াটিয়া অবজারভার পর্যবেক্ষকও সেটি বলেছেন। ২৭ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটের ঘোষণা মিথ্যা প্রকাশ হয়ে গেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবের বক্তব্যে। কানে কানে শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্যই দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা। ভোট বর্জন হয়েছে। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচনে বাধা দিতে যাইনি। নিজেরা নিজেরা ডামি প্রার্থী বানিয়ে ৬৩ জন ডামি স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছে। জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন বণ্টন করেছিল। তার মধ্যে ১১টা জিতেছে। ক্রেন দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে কিছু লোককে জেতানোর জন্য। গণতন্ত্র, নির্বাচন, সংবিধান– এগুলো নিয়ে রসিকতা করার কোনো অধিকার কারও নেই।