বাংলাদেশের শহরগুলোতে ধর্ম, উপার্জনের সক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধাসহ নানা ধরনের বিষয়কে ঘিরে গত ১০ বছরে আশঙ্কাজনক বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। একই সঙ্গে শহরতলিতে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত বসতি স্থাপনের ফলে শ্রেণিবৈষম্য বাড়ছে। এ ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বসবাসের অযোগ্য শহর তৈরি হচ্ছে। আন্তঃদেশীয় একটি গবেষণার বাংলাদেশ অংশের ফলাফলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আটটি দেশের ৯টি সংস্থা বৃহৎ এই প্রকল্পে কাজ করছে। মূল অর্থদাতা যুক্তরাজ্য সরকার। সেন্টার ফর সাসটেইনেবল, হেলদি অ্যান্ড লার্নিং সিটিজ অ্যান্ড নেইবারহুডস (এসএইচএলসি) আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের প্রকল্পটির কাজ চলছে সাতটি উন্নয়নশীল দেশে। এর জন্য প্রতিটি দেশের দুটি করে বড় ও ছোট শহর বেছে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঢাকা ও খুলনা শহরকে বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নগরায়ণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর টেকসই সমাধানে চার বছর ধরে কাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে গবেষণাকর্মটির সঙ্গে যুক্ত আছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা (ইউআরপি) ডিসিপ্লিন।
গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব দেওয়া খুবির ইউআরপি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক শিল্পী রায় বলেন, বাংলাদেশের শহরগুলোর সামাজিক বিভাজন ও শহরতলির পরিবর্তন উদ্বেগজনক। এ উদ্বেগবার্তায় নীতিনির্ধারকরা সাড়া দিলে আমাদের গবেষণা সার্থক হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ নগরায়ণ :গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে আশঙ্কাজনক হারে নগরায়ণ হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা শহরের আয়তন ৩০৭ বর্গকিলোমিটার। তবে গত ৩০ বছরে ঢাকার আশপাশে ২৫৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়ে উঠেছে। একই সময়ে খুলনায় বেড়েছে প্রায় ১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা; মোট আয়তন ৪৬ বর্গকিলোমিটার। ঢাকায় গড়ে প্রতিবছর ৮ শতাংশ হারে নগরায়ণ হচ্ছে, যে হার খুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ।
নতুন গড়ে ওঠা এসব বসতি কেড়ে নিয়েছে কৃষিজমি ও জলাভূমি। নগরায়ণের এই প্রক্রিয়ায় ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হারিয়েছে ২৩৪ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি এবং ৩২ বর্গকিলোমিটার গাছপালা ও জলাভূমি। অন্যদিকে, খুলনায় হারিয়ে গেছে প্রায় ৪২ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি ও প্রায় পাঁচ বর্গকিলোমিটার জলাশয়।
শহরের বাইরে অপরিকল্পিতভাবে দ্রুতগতিতে নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এখানে সুপেয় পানি, পয়ঃনিস্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সড়ক যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সেবার অপ্রতুলতা রয়েছে। শহরের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন একটা লাগেনি। এর ফলে শহরের ভেতরে এরই মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ প্রায় ৭০ শতাংশ মহল্লা আরও ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে।
সামাজিক বিভাজন :ঢাকা ও খুলনা উভয় শহরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান শহরজুড়ে বাস করছে। তবে সনাতন ও খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীরা বাস করছে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়। যেমন- রাজধানীর পুরান ঢাকা ও খুলনার বড়বাজার এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাসের হার মূল শহরের তুলনায় যথাক্রমে ১০ গুণ ও দ্বিগুণের বেশি। ধর্মের এই প্রান্তিকতা বাড়তে থাকলে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সময় ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে।
ধর্ম ছাড়াও ঢাকা শহর সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিভাজিত। নগরীর কিছু জায়গা অভিজাত মানুষের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। আয়ের ভিত্তিতে ঢাকা শহর আট ও খুলনা শহর পাঁচ শ্রেণিতে বিভাজিত হয়ে পড়ছে।
উভয় শহরেই নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে স্থানিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। ঢাকার ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ বাড়িতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। খুলনায় এই চিত্র আরও ভয়াবহ। ঢাকা শহরে গত ২০ বছরে সরকারি উদ্যোগে কোনো বিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। বেশির ভাগ মধ্য ও নিম্ন আয়ের এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় মানসম্মত স্কুল অপ্রতুল। তবে অভিজাত আবাসিক এলাকায় ব্যয়বহুল ও মানসম্মত স্কুল আছে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা উভয় শহরে নাজুক। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ক্লিনিক, ফার্মেসি ইত্যাদি গড়ে ওঠায় যানজট সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার প্রান্তিক এলাকার মানুষকে এ সুবিধা নিতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।
সুপারিশ ও সমাধান :বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া নানা পরিকল্পনার অধীনে ঢাকায় কিছু উন্নয়নকাজ হলেও খুলনার ক্ষেত্রে সেটি একেবারেই কম। এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গবেষকরা নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে চারটি প্রধান সুপারিশ করেছেন। প্রথমত, ঢাকা ও খুলনা উভয়ের জন্য শহরতলির পরিকল্পনাটাই আগামীর মূল চ্যালেঞ্জ। তবে এ পরিকল্পনা শহরের ভেতর থেকে শহরের বাইরের এলাকার জন্য বেশি প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, শহরে মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে বিভাজনটা কমানো প্রয়োজন। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা খুবই জরুরি। তৃতীয়ত, পরিকল্পনা বাস্তবতার আলোকে ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে তৈরি করতে হবে। এখানে পশ্চিমা ধারণার প্রভাব কমিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে পরিকল্পনাগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতে বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। চতুর্থত, ঢাকা শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। মানুষের মাঝে রাজধানীমুখী হওয়ার প্রভাব না কমাতে পারলে শুধু ঢাকা নয়, খুলনাসহ অন্য শহরগুলোর সমস্যা দূর হবে না। তবে এ বিষয়ে শুধু ঢাকা বা খুলনাকে নিয়ে ভাবলে হবে না। জাতীয় পর্যায়ে মানুষের জীবনব্যবস্থার একটা চিত্র দাঁড় করাতে হবে। পাঁচ বছরব্যাপী জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে নগরায়ণ পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটাতে হবে। আবার মহল্লা পর্যায়ে গবেষণা ও পরিকল্পনা বাড়াতে হবে।
এসএইচএলসি প্রকল্পের ইন-কান্ট্রি কো-ইনভেস্টিগেটর এবং খুবির ইউআরপি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক তানজিল সওগাত বলেন, নগরায়ণের যে গতিপ্রকৃতি আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, তা নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় না আনলে আমরা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ব্যর্থ হবো।

বিষয় : মানুষে মানুষে বিভাজন বৈষম্য বাড়ছে

মন্তব্য করুন