- বাংলাদেশ
- ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো’
দেয়াল লিখনে শাবি উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি
‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো’

শাবিতে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে দেয়াল লিখন। ছবি: সমকাল
আবাসিক হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগে তিন দফা দাবির আন্দোলন পরবর্তীতে রূপ নিয়ে এক দফায়। শিক্ষার্থীদের দাবি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ। এ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নানা ধরনের ‘দেয়াল লিখন’। যেসবে স্থান পেয়েছে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা স্লোগান ও সাহিত্য থেকে নেওয়া অনুপ্রেরণা দেয় এমন বাক্য।
মূলত ঘটনার পটপরিবর্তনের জন্য দায়ী ১৬ জানুয়ারি পুলিশের লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে উপাচার্যকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। পুলিশি এ হামলায় প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হন। এর পর থেকেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনের মতো কর্মসূচিও পালন করেছেন। এ সময় মিছিল স্লোগানে ক্যাম্পাস ছিল উত্তাল। এখনও শিক্ষার্থীরা নানা পন্থায় আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। যার মধ্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে দেয়াল লিখন আর গ্রাফিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো এখন রূপ নিয়েছে প্রতিবাদের প্রাচীরে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেয়াল লিখন শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের একটি মাধ্যম। পুলিশি হামলার পর থেকে আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী এসব দেয়াল লিখন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সুদীপ্ত ভাস্কর অর্ঘ্য বলেন, উপাচার্যের পদত্যাগ দাবির আন্দোলনে উত্তাল ক্যাম্পাস, সেই সময়ের আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের মনোবল, প্রশাসনের ভূমিকার কথা এসব দেয়াল লিখনে প্রকাশ পেয়েছে। এ ছাড়াও অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী করে তুলতে দেয়াল লিখনের কথাগুলো ভূমিকা পালন করেছে।
‘শিল্প ও সাহিত্য যে কোনো আন্দোলনের অংশ হতে পারে। দেয়াল লিখনে সাহিত্যের প্রতিবাদী কথা, কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তি, সড়কে লেখা স্লোগান এবং দেয়ালের গ্রাফিতি এর উদাহরণ বলা যায়’, যোগ করেন অর্ঘ্য।
উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে দেয়াল লিখন নিয়ে আন্দোলনরত বেশকিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলা হলে তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান।
ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের নিচ তলার ভেতরের দিকে লেখা, ‘আসবে ঝড়, নাচবে তুফান’।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী জাহিদুর ইসলাম অপূর্ব বলেন, যখন পুলিশি হামলার শিকার হন শিক্ষার্থীরা, এর পরদিন থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেই সময়ের পরে দেয়ালে এই কথাটা লিখা হয়। শুধু এটি নয় সেসময় ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’, ‘এই ক্যাম্পাসে স্বৈরাচারীর ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ ও ‘সব জুলুমশাহীর পতন হোক’ও লেখা হয়।
উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন অবরুদ্ধ হলে যেখানে পুলিশি হামলার শিকার হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা সেখানকার দেয়ালে লেখা, ‘ফুলের বিনিময়ে পেয়েছি বুলেট, শান্তির বিনিময়ে সংঘাত’।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আবেদিন বলেন, উপাচার্য অবরুদ্ধ হলে ক্যাম্পাসে পুলিশ আনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তখন শিক্ষার্থীরা পুলিশকে ফুল দিয়েছিল। কিন্তু এরপরও পুলিশি হামলা হয় আমাদের উপর। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে সে মুহূর্তের কথা ‘ফুলের বিরুদ্ধে বুলেট হলে বুলেটের বিরুদ্ধে কী!’, ‘হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো’, ‘আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন/ মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়’, ‘মরবো নাকি মুক্ত হবো’, ‘ওরে ও পাগলা ভোলা দে রে দে প্রণয় দোলা’, ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’ কথাগুলো দেয়ালে লেখা হয়।
এদিকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে প্রায় সব ভবনে দেয়াল লিখন দেখা যায়। গ্রন্থাগারের সামনের দেয়ালে লিখা রয়েছে, ‘যাদের পায়ের ছাপে রক্তের দাগ/ যাদের উঠোন জুড়ে পুলিশি বাঁধা/ যাদের প্রিয় গান সাইরেনের সুর/ যাদের কথার ভাঁজে শুধুই ধাঁধা/ তাদের পতন হোক!’, ‘আমি জানি আমি জানি হীরক ভিসির শয়তানি’ ও ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’।
অন্যদিকে ক্যাম্পাসের আরও একটি দেয়ালে লেখা, ‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়ালে আয়ু বেড়ে যায়’।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সাবরিনা হিয়া বলেন, উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে প্রথমে ২৪ জন শিক্ষার্থী এবং পরে গণঅনশন ঘোষণা করলে আরও ৫ জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশনে বসেন। সে সময় অনশনরত অসুস্থ শিক্ষার্থীদের মুহূর্তের কথা এটি। সেই সময়ে আরও কিছু কথা দেয়ালে লেখা হয়েছিল। সেগুলো হলো— ‘বিদ্রোহী মানে কাউকে না মানা নয়, যা বুঝি না তা মাথা উঁচু করে বুঝি না বলা’, ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’, ‘সাড়া দাও সাড়া দাও উদাসীন থেকো না’, ‘আমরা সবাই সাস্টিয়ান, চাষাভুষার সন্তান’, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পারি দিবো রে’।
এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দক্ষিণ পাশের দেয়ালে লাল রঙে লেখা ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো'।
এ বিষয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী মীর রানা বলেন, এ লাইন জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ থেকে নেওয়া। এখানে দেয়ালের এই লেখা একদিকে আমাদের প্রতিবাদ এবং দাবি না মানলে আমরা সব শিক্ষার্থী আরও বড় জমায়েত নিয়ে একসঙ্গে আন্দোলন চালাব, সে বিষয়টি বুঝানো হয়েছে। অন্যদিকে পহেলা ফাল্গুন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। সেদিন আমরা আমাদের আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানাতে পারি।
এদিকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনুরোধে তাদের সঙ্গে কথা বলতে শুক্রবার ক্যাম্পাসে আসার কথা রয়েছে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির।
মন্তব্য করুন