- বাংলাদেশ
- বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ধুঁকছে, প্রাণী ভুগছে
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ধুঁকছে, প্রাণী ভুগছে

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব পেরোলেই গাজীপুরের শ্রীপুরের বাঘের বাজার। মহাসড়ক থেকে সরু রাস্তায় ঢুকে আরও চার কিলোমিটার। এবড়োথেবড়ো রাস্তার যন্ত্রণা সইয়ে মূল ফটক। থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ড ব্যাংককের আদলে তৈরি প্রাণিরাজ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক।
সেই আশাজাগানিয়া সাফারি পার্কটিই এখন গণমাধ্যমের ক্রম শিরোনাম। সবার কৌতূহলী ও অনুসন্ধানী চোখও সেখানে। বন্যপ্রাণীর এই অভয়ারণ্য এখন যেন এক মৃত্যুপুরী। একের পর এক প্রাণীর মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন সবাই।
সমকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক অনুসন্ধানে গিয়ে পেয়েছে অনিয়ম, অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার রকমারি ছবি।
১১টি জেব্রা, একটি সিংহী ও বাঘ মারা যাওয়ার ঘটনার পরও বন্ধ হয়নি প্রাণীর প্রতি অনাদর। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিদেশি প্রাণী ব্যবস্থাপনা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা তুলেছেন প্রশ্ন।
তারা বলছেন, এ দেশের আবহাওয়ায় বিদেশি প্রাণী লালন-পালনে যে রকম ব্যবস্থা থাকা দরকার, তা নেই বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। বিষয়টি নিয়ে মনোযোগী না হলে আরও প্রাণী মারা যাওয়ার শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
কেমন আছে প্রাণিকূল
গত সোমবার সাফারি পার্কে গিয়ে চোখ পড়ল বাঘ বেষ্টনীতে। সেখানকার হাড্ডিসার এক বাঘ দাঁড়াতেই পারছিল না। পাশের বেষ্টনীতে একটি সিংহেরও একই দশা। একের পর এক মৃত্যুর পরও জিরাফ ও জেব্রাকে ঘাস খাওয়ানো হচ্ছে পাত্রের বদলে মাটিতে রেখে। আর মাংসাশী প্রাণীকে খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের
পরীক্ষা ও নিরাপদ খাবার দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। পরীক্ষা কিংবা পরখ করার কোনো 'নামগন্ধ' নেই। নোংরা পরিবেশে কাটা মাংস বাজার থেকে সরাসরি এনে দেওয়া হচ্ছে প্রাণীকে। জেব্রা যে খাবার খায় তাতেই আবার মুখ দেয় বানর। এক পাত্রে খাবার দেওয়া হয় একাধিক প্রাণীকে।
পার্কের প্রাণী সুরক্ষায় মেডিকেল বোর্ড গত ২৬ জানুয়ারি ১০টি প্রস্তাব দিয়েছিল। দুই সপ্তাহ পার হলেও এসব প্রস্তাবের বেশিরভাগই বাস্তবায়নের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বাঘ-সিংহকে দেওয়া খাবারের মান নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। মাংসাশী প্রাণীদের খাবারে মাংসের চেয়ে বেশি থাকে হাড়।
গত সোমবার বিষয়টি ধরা পড়ে বন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহারের চোখেও। তিনি সরেজমিন সাফারি পার্ক ঘুরে দেখার সময় এক কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে বলেন, 'শুধু একটা হাড্ডি দিয়েছ, মাংস দাওনি কেন?'
এদিকে, এখনও শেষ হয়নি নতুন বেষ্টনীর কাজ। লেকের পানি এরই মধ্যে সেচে ফেলা হলেও জীবাণুমুক্ত করে নতুন পানির ব্যবস্থা করা হয়নি। এখনও প্রাণীগুলোকে আনা হয়নি টিকার আওতায়। বেষ্টনীর মাটি জীবাণুমুক্ত করার কাজও শেষ হয়নি পুরোপুরি। জেব্রার আলাদা বেষ্টনী এখনও তৈরিই হয়নি।
এক কর্মকর্তা বলেন, সাফারি পার্কে প্রাণীদের খাবারের মান যাচাইয়ের কোনো পরীক্ষাগার নেই। খালি চোখে দেখে খাবারের মান যাচাই সম্ভব না হলেও চলছে এভাবেই। পানি ও পয়োনিস্কাশন ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত।
এদিকে, পার্কের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জেব্রা যেখানে বাস করে, সেখানে রয়েছে শালবন। সেখানে জেব্রার খাবারের অনুপযোগী উদ্ভিদ ও লতাপাতা রয়েছে। বদ্ধ নালায় জমে থাকে পানি। জেব্রার বাসের জন্য অনেকটা অনুপযুক্ত ওই এলাকা। এ ছাড়া জেব্রার সঙ্গেই এক বেষ্টনীতে রাখা হয়েছে শিংওয়ালা জিরাফ, ওয়াইল্ড বিস্ট, কমন ইল্যান্ড। সঙ্গে রয়েছে শত শত বানর।
নির্দিষ্ট প্রাণীর বেষ্টনীর কাজ শেষ না হওয়ায় প্রায়ই দলে দলে ঢুকে পড়ে শিয়াল, বানরসহ অন্যান্য প্রাণী। শিয়াল হরিণের বাচ্চা খেয়ে ফেলবে- এমন শঙ্কায় গত ডিসেম্বরে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে ২০টি শিয়াল মারা হয়। এর আগে আরও ১৫ থেকে ২০টি শিয়াল মারা হয়েছিল।
শুধু নেই আর নেই
এক চিকিৎসক দিয়ে চলছে প্রায় চার হাজার প্রাণীর চিকিৎসা। দক্ষ জনবলস্বল্পতা, উপযুক্ত চারণভূমি এবং প্রাকৃতিক খাবারের অভাব রয়েছে পদে পদে। জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ চলে গেলে রাতে পুরো এলাকায় নামে আঁধার।
পার্কের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, টাকার অভাবে নিয়মিত কাজ করা যায় না। প্রকল্পের ২২৫ কোটি টাকার মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ খরচ হয়ে গেছে ২২০ কোটি টাকা। পার্কে ১৩৮টি পদ থাকার দরকার হলে আছে মাত্র ৬০টি পদ। পার্কের প্রাণীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজিস্ট, বন্যপ্রাণীর স্বাস্থ্য এবং খাদ্যের মান ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বন্যপ্রাণী পুষ্টিবিদ, শিক্ষা উপকরণ তৈরির জন্য এডুকেশন অফিসার বা কিউরেটরের পদ নেই।
পার্কটির প্রকল্প পরিচালক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, 'বিদেশি বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলো আমাদের রপ্ত করতে হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, 'নতুন জনবল কাঠামোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে। সেটার অনুমোদন হলে পার্কের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।'
কেউ ভয়ে, কেউ স্বস্তিতে
প্রাণী মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ওয়াইল্ড লাইফ সুপারভাইজার সারোয়ার হোসেনকে। এর আগে সরিয়ে নেওয়া হয় পার্কের প্রকল্প কর্মকর্তা মো. জাহিদুল কবির, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান ও বন্যপ্রাণী চিকিৎসা কর্মকর্তা হাতেম জুলকারনাইনকে। আরও অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন আতঙ্কে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক বছর সাফারি পার্কে কর্মকর্তারা দু'পক্ষে বিভক্ত।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান ও পার্কটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রকল্প পরিচালক ড. তপন কুমার দে পার্কের দরপত্রসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি সবার জানা। এ বিরোধ মাঝে মারামারিতেও রূপ নেয়। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে খোদ স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজেরও।
জানা যায়, ড. তপন কুমার দে নিজেই এখানে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবিবুর রহমানকে সরিয়ে দেওয়ার পর নতুন করে তপন কুমার পার্কে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। গত সোমবার পার্কে তাকে দেখা গেলেও এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রাণীর প্রতি অনাদর নতুন নয়
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৩-২০১৫ সাল পর্যন্ত দুই ধাপে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মোট ২৫টি জেব্রা পার্কে আনা হয়। এসব জেব্রা অবমুক্ত করার পর নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরে ২০১৫ সালের মধ্যেই ১১টি জেব্রার মৃত্যু হয়। পার্কে প্রথম জেব্রা শাবকের জন্ম হয় ২০১৭ সালের ১৪ মে। সেই থেকে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২৫টি শাবকের জন্ম হয়। এর মধ্যে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে জেব্রা মারা যায় ১০টি।
গত ২ থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে মৃত্যু হয় আরও ১১টি জেব্রার। সব মিলিয়ে পার্কে মারা গেছে ৩২টি জেব্রা। সর্বশেষ ১১টি মারা যাওয়ার পর এখন জেব্রা আছে ২০টি।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৭ মে পার্কে অজানা রোগে দুটি জিরাফের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি মারা যায় আরেকটি জিরাফ। ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পার্কের একটি সাদা সিংহ মারা যায়। এ ছাড়া ৩ ফেব্রুয়ারি পার্কে ফের অসুস্থ হয়ে একটি সিংহীর মৃত্যু হয়। গত ১২ জানুয়ারি পার্কে অ্যানথ্রাক্সে একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছিল। এর আগে আরও একটি বাঘের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া পার্ক প্রতিষ্ঠার পর দর্শনার্থীদের জন্য বেশ কয়েকটি ক্যাঙ্গারু বিদেশ থেকে আনা হলেও ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা এখন শূন্যতে পৌঁছেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রাণী মারা গেলেও তা গোপন রাখার চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। আলোচনায় আসার পর প্রতিবারই ঘটা করে তদন্ত কমিটি গঠনসহ আনুষ্ঠানিক সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে সাফারি পার্কের একাধিক সূত্র বলেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির সুপারিশকে অবহেলা করা হয়েছে। দায়সারা ময়নাতদন্ত ও কমিটি করেই ক্ষান্ত কর্তৃপক্ষ।
জেব্রার মৃত্যু নিয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য
খাবারে ব্যাকটেরিয়া ও মারামারিতে জেব্রার মৃত্যু হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ শুরুর দিকে দাবি করলেও এখন বেরিয়ে আসছে নতুন তথ্য। এর আগে সমকালের অনুসন্ধানে ঘাসে নাইট্রেট ও ব্যাকটেরিয়া ছিল বলে তথ্য মিলেছিল। নতুন করে ঘাসে মিলেছে সিসা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ও জেব্রার মৃত্যু নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, ঘাসে নাইট্রেট, ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক ও সিসা পাওয়া গেছে। শিল্পকারখানা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া থেকে সিসার উৎপত্তি হতে পারে। তিনি বলেন, আটটি জেব্রা নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। তাদের শরীরে বিষক্রিয়াও পাওয়া গেছে। তিনটি জেব্রার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল জানান, ইতোমধ্যে সিআইডি নমুনা সংগ্রহ করেছে। কোনো অপরাধবিষয়ক ঘটনা ঘটেছে কিনা তাও সিআইডি দেখবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, বিদেশি ও দেশীয় প্রাণীর ব্যবস্থাপন পদ্ধতিতে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাই বিদেশি প্রাণীর দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজনীতা রয়েছে।
১৩ প্রাণীর মৃত্যুরহস্য এখনও অজানা
দুই সপ্তাহ পার হলেও ১৩ প্রাণীর মৃত্যুরহস্য এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে তদন্ত কমিটি। গত বুধবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সময় বেড়েছে আরও ১০ কর্মদিবস। নতুন করে তদন্ত কমিটির পরিধি বাড়িয়ে পাঁচ থেকে আটজন করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এদিকে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গঠন করেছে তিন সদস্যের ছায়া তদন্ত কমিটি। মূল কমিটিকে তারা সহযোগিতা করবে।
মন্তব্য করুন