অতিমারির এই দুঃসময়ে উচ্চ মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোলেন আরও একদল শিক্ষার্থী। শিক্ষাজীবনের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পা ফেলার স্বপ্ন বুনন এখন থেকেই তাদের অন্তরজুড়ে। করোনার কারণে ২০২০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসানো যায়নি শিক্ষার্থীদের। সবাই হয়ে যান স্বয়ংক্রিয় উত্তীর্ণ (অটোপাস)। পরীক্ষার্থীদের আগের দুই পাবলিক পরীক্ষার (এসএসসি ও জেএসসি) সাবজেক্ট ম্যাপিং করে দেওয়া হয় নম্বরপত্র। এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনাও ছিল বেশ। এবার আর সেই পথে হাঁটেনি সরকার। পরীক্ষার্থীরাও অটোপাসে ছিলেন না রাজি। ২০২১ সালের পরীক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি ছোট করে পরীক্ষার টেবিলে বসানো হয়।

গত ২ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এতে বড় সফলতা দেখিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে পাসের হার ছিল মাত্র ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, এবার তা বেড়ে হয়েছে ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। সে হিসাবে পাসের হার বেড়েছে ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বিশ্নেষকরা মনে করেন, এক লাফে পাসের হার এতটা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ ছোট পাঠ্যসূচিতে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা।

২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ছয়টি বিষয়ে ১২টি পত্র ও আইসিটি মিলিয়ে মোট ১৩টি পত্রে দিতে হয়েছে পরীক্ষা। এবার ২০২১ সালের পরীক্ষার্থীদের মাত্র তিন বিষয়ের ছয়টি পত্রের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া প্রশ্নপত্রে উত্তর দেওয়ার অপশনও অনেক বেশি ছিল এবার। এসবের সুফল ঘরে তুলেছেন পরীক্ষার্থীরা। কম বিষয় ও কম পত্রের পরীক্ষা হওয়ায় তারা মনোযোগ দিতে পেরেছেন বেশি। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ের প্রায় আট মাস পর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় পরীক্ষার্থীরা সময়ও পেয়েছেন বেশি। আবার ইংরেজি ও গণিতের মতো কঠিন বিষয়ের পরীক্ষায় অবতীর্ণ না হতে হওয়ায় তারা ছিলেন অনেকটাই নির্ভার। এ দুটি বিষয়সহ অন্য বিষয়ে এই শিক্ষার্থীদের গত দুটি পাবলিক পরীক্ষা তথা এসএসসি ও জেএসসির সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফল দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, আগের পরীক্ষা দুটিতে ভালো করা বেশির ভাগ পরীক্ষার্থীই পরীক্ষা না হওয়া বিষয়গুলোতে বেশি নম্বর পেয়েছেন। সাবজেক্ট ম্যাপিং তাদের জন্য সুফল বয়ে এনেছে।

২০২১ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফল গতকাল রোববার প্রকাশ হয়েছে। এবার দেশের ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পাস করেছেন। সব বোর্ডে ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৩ লাখ ছয় হাজার ৭১৮ জন পাস করেছেন। এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ১১ লাখ ১৫ হাজার ৭০৫ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছেন ১০ লাখ ৬৬ হাজার ২৪২ জন। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে এইচএসসি পাসের হার ৯৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম পরীক্ষায় এক লাখ ছয় হাজার ৫৭৯ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছেন এক লাখ এক হাজার ৭৬৮ জন। পাসের হার ৯৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় এক লাখ ৪৯ হাজার ৩৯৭ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন এক লাখ ৩৮ হাজার ৭০৮ জন। পাসের হার ৯২ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

এবারের পরীক্ষার্থীরা জিপিএ ৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও রেকর্ড গড়েছেন। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে এ বছর এক লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ পরীক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছেন। ২০১৯ সালে জিপিএ ৫-এর এই সংখ্যাটা ছিল এক লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন। এবার জিপিএ ৫ বেশি পেয়েছেন ২৭ হাজার ৩৬২ জন।

গতকাল সকালে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশ করা হয়। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ফল প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ফলের বিস্তারিত তুলে ধরে প্রেস ব্রিফিং করেন। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

ফল প্রকাশের পরপরই সারাদেশের স্কুল, মাদ্রাসায় বয়ে যায় আনন্দ-হিল্লোল। পরীক্ষার্থীরা একে অপরকে জড়িয়ে প্রকাশ করতে থাকেন উচ্ছ্বাস।

ফলের নানা দিক: শুধু চট্টগ্রাম বাদে বাকি ১০ শিক্ষা বোর্ডেরই পাসের হার এবার ৯২ শতাংশের ওপরে। চট্টগ্রামে পাসের হার ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যশোর বোর্ডে পাসের হার শতক ছুঁইছুঁই, যা ৯৮ দশমিক ১১ শতাংশ। পাসের হারে শীর্ষে যশোর হলেও জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে শীর্ষে ঢাকা। বরাবরের মতোই মেয়েরা এবার ছেলেদের পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছেন। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা পাসের হারে এগিয়ে থাকলেও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে সংখ্যায় বেশি।

২০২০ সালে এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা যখন দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হন, তার আগেই দেশে করোনা শুরু হয়। পদে পদে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটেছে তাদের। ২০২১ সালের সংশোধিত ও পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচিতে গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে ছয়টি পত্রে পরীক্ষা হয়। বাংলা, ইংরেজি, আইসিটিসহ অবশিষ্ট বিষয়গুলোর নম্বর এসএসসি/সমমান ও জেএসসি/জেডিসি থেকে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জেএসসি/সমমানের ২৫ এবং এসএসসি/সমমানের ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনায় নেওয়া হয়। চতুর্থ বিষয়ের ক্ষেত্রে যে তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সে বিষয়গুলো ছাড়া চতুর্থ বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এসএসসি/সমমান পরীক্ষার বিষয় ও জেএসসি/জেডিসি পর্যায়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় থেকে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে নম্বর নির্ধারণ করা হয়।

বিশ্নেষকরা যা বলছেন: এবারের ফল নিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, সবচেয়ে বড় কথা এ পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মানসিক প্রশান্তি পেয়েছে। অটোপাস নয়, পরীক্ষা দিয়ে পাস করে তারা আজ হাসছে। এটাই বড় প্রাপ্তি মনে করি। তিনি বলেন, ইংরেজির মতো কঠিন বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, যারা ইংরেজিতে দুর্বল তারা পার পেয়ে গেছে। জেএসসি ও এসএসসির সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে সুবিধা পেয়েছে সবাই।

পাসের হারে শীর্ষে থাকা যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহসান হাবীব বলেন, প্রশ্নের চয়েস অপশন বেশি থাকায় শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো উত্তর দিতে পেরেছে। এটিও ভালো ফলের অন্যতম কারণ।

কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, পরীক্ষার নম্বর ও সময় কমিয়ে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণে পরীক্ষার্থীরা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিতে পেরেছে। এতে ভালো ফল পেয়েছে তারা।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রমা বিজয় সরকার বলেন, এপ্রিলের পরীক্ষা ডিসেম্বরে হওয়ায় পরীক্ষার্থীরা বাড়তি সময় পেয়েছে। ১৩টি পত্রের বদলে ছয়টি পত্রের পরীক্ষা হওয়ায় তারা অনায়াসে সাফল্য বয়ে এনেছে।

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাবীবুর রহমান বলেন, এত ভালো ফলের পরও ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এটা হওয়ার কথা ছিল না।

শিক্ষামন্ত্রীর ব্রিফিং: ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে উত্তীর্ণদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ফল প্রকাশের ব্রিফিংয়ে শিক্ষার্থীদের 'মানবিক' করে গড়ে তুলতে অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আপনার সন্তানকে অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেবেন না। স্বার্থপর করে গড়ে তুলবেন না।' শিক্ষামন্ত্রী বলেন, 'জাতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ এবং গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার্থীদের বলব, যদি মূল্যবোধ তৈরি না হয়, বেশি নম্বর পেয়ে কী হবে। মানবিক গুণে গুণান্বিত হও, চারপাশে তাকাও, মানুষকে ভালোবাসো। নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠো, স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হও, নিঃস্বার্থ চিত্তে মানব কল্যাণে নিবেদিত হও।'

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে ইউজিসিসহ তাদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং বলছি। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের জন্য এই সুযোগ যদি বাড়াই, তাতে তো অসুবিধা নেই।

আজ থেকেই করা যাবে ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন: গতকাল প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন আজ সোমবার থেকেই করা যাবে। শুধু টেলিটক প্রি-পেইড নম্বর থেকে আবেদন করতে মোবাইল ফোনের মেসেজ অপশনে গিয়ে RSC বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর রোল নম্বর বিষয় কোড লিখে Send করতে হবে ১৬২২২ নম্বরে।

পুনর্নিরীক্ষণের ক্ষেত্রে একই এসএমএসের মাধ্যমে একাধিক বিষয়ের/পত্রের জন্য আবেদন করা যাবে। সেক্ষেত্রে কমা দিয়ে বিষয়/পত্রের কোডগুলো আলাদা করে লিখতে হবে। যেমন- পদার্থ ও রসায়ন দুটি বিষয়ের/পত্রের জন্য টেলিটক প্রি-পেইড নম্বর থেকে মোবাইল ফোনের মেসেজ অপশনে গিয়ে RSC Dha < Space> Roll Number ১৭৪, ১৭৫, ১৭৬, ১৭৭ লিখতে হবে। প্রতি পত্রের জন্য আবেদন ফি ১৫০ টাকা। দুই পত্রবিশিষ্ট বিষয়ের একটি পত্রে কিংবা দুটি পত্রে আবেদন করতে পারবে। ম্যানুয়াল কোনো আবেদন নেওয়া হবে না।