প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনার পদে যাদের নামের প্রস্তাব এসেছে এবং আসবে, তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সার্চ কমিটি। গতকাল রোববার বিশিষ্টজনের সঙ্গে তৃতীয় বৈঠকের শুরুতেই এ কথা জানান কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আজ সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে এ তালিকা প্রকাশ করা হবে।

বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল ইসি গঠনের জন্য নাম প্রস্তাব করেনি, তাদেরও আজ সোমবার বিকেল ৫টার মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ই-মেইলে তালিকা পাঠানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এ তালিকাও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এরপর প্রস্তাবিত তালিকা নিয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে বৈঠকে বসবে সার্চ কমিটি।

এর আগে শনিবার বিশিষ্টজনের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করে রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটি। সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল তৃতীয় বৈঠকে ২৩ জন আমন্ত্রিত ব্যক্তির মধ্যে ১৮ জন উপস্থিত ছিলেন। আর সার্চ কমিটির পাঁচ সদস্যের পাশাপাশি সচিবের দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিব উপস্থিত ছিলেন।

গতকাল বৈঠকে বিশিষ্টজন সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরেছে সার্চ কমিটিকে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য সৎ, সাহসী, দুর্নীতিমুক্ত ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকদের নিয়ে যাতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে।

গতকাল সার্চ কমিটির বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বৈঠকে উপস্থিত অধিকাংশ বিশিষ্টজন প্রস্তাবিত নামের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশের কথা বলেছেন। তাই কমিটিও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ পর্যন্ত পাওয়া ৩২৯ জনের নাম এবং সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল তালিকা দেয়নি, তাদের কাছ থেকে পাওয়া নামসহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।

এর আগে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের গোলাম কুদ্দুছ, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, গণহত্যা জাদুঘরের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সাবেক অ্যাডিশনাল আইজিপি নুরুল আলম, গীতিকার ও সুরকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক, সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত, অর্থনীতিবিদ ড. তোফায়েল আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত নিমচন্দ্র ভৌমিক, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, প্রজন্ম ৭১-এর সভাপতি আসিফ মুনীর তন্ময় ও শহীদসন্তান ডা. নুজহাত চৌধুরী।

বৈঠক শেষে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'আমি কোনো প্রস্তাব দিইনি। আমি কতগুলো মত দিয়েছি। মতটি হলো, সার্চ কমিটি করুন, চারশ বা পাঁচশ লোক বের করুন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। মানুষের কোনো বিশ্বাস নেই। এ বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে যে লোকগুলোর প্রয়োজন, তাদের অনুসন্ধান করুন। যার দ্বারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে সেই সাহস তারা রাখেন, সেই ধরনের লোক খুঁজে বের করুন।'

আগামী নির্বাচনে ইসি গঠনের গুরুত্ব তুলে ধরে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, 'আগামী নির্বাচন যদি আগের মতো হয়, তাহলে আমরা বাংলাদেশিরা একটা বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। রাজনীতির যত খেলাই হোক, নির্বাচন যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য না হবে, ততক্ষণ দেশে-বিদেশে আমাদের সমস্যা আছে। কাজেই এগুলো মাথায় রাখতে হবে।'

সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, 'আগামী নির্বাচন হতে হবে সর্বজন-গ্রহণযোগ্য। আমি বলছি না- শতভাগ গ্রহণযোগ্য হতে হবে। শতভাগ গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন হয় না। নির্বাচন হতে হবে যারা ভোট দিচ্ছে, ভোট দিতে পারছে বা ভোট দিতে পারবে, তাদের মতামতের যাতে প্রতিফলন ঘটে।'

নাম প্রস্তাবকারী রাজনৈতিক দলের নাম প্রকাশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের সংবিধানে বলা আছে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এখানে বলা নেই দলভিত্তিক নির্বাচন কমিশন। বিশ্বে তিন-চার রকমের নির্বাচন কমিশন আছে। দলভিত্তিক আছে; সরকারি নির্বাচন কমিশন আছে; স্বাধীন নির্বাচন কমিশন আছে। এখানে কোনো দল যদি নাম দিয়ে থাকে, তিনি যত ভালো ব্যক্তিই হোন না কেন; তিনি অত্যন্ত সাহসী ব্যক্তি হতে পারেন, ভালো ব্যক্তি হতে পারেন; অথবা তার চাইতে সৎ ব্যক্তি কেউ নেই; তার ওপর দলের ছাপ পড়ে যাবে। যেটা আমরা গত নির্বাচন কমিশনে দেখেছি।'

নাম প্রস্তাবকারী দলের নাম প্রকাশের প্রয়োজন রয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'যত নাম দিয়েছে সব নাম প্রকাশ করা হোক। আর যদি স্বাধীন নির্বাচনের কথা বলেন, তাহলে দলের প্রস্তাব নিতে আমার আপত্তি আছে। কোনো দলের প্রস্তাব আমি নিতে চাই না।'

অধ্যপক জাফর ইকবাল বলেন, 'আমাদের সবার প্রস্তাব একটাই- আমাদের এমন একটা দেশ তৈরি হবে, সে দেশে যারাই রাজনীতি করবেন, তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে হবে। যতদিন সেটা না হচ্ছে, ততদিন আমরা বুঝব, আমাদের দেশে রাজনীতি সঠিকভাবে হচ্ছে না।'

সর্বজন-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এ দেশে এখনও স্বাধীনতাবিরোধী লোক আছে। তারা কি একজন স্বাধীনতার পক্ষের কোনো মানুষকে গ্রহণ করবে? কাজে সর্বজন-গ্রহণযোগ্য কথাটা একটু জটিল। আমরা সার্চ কমিটিকে বলেছি, আপনারা ভয় পাবেন না। আপনারা এমন লোক বাছাই করুন, যারা নিজের বিবেকের কাছে ঠিক থাকবেন। তারা সাহসী থাকবেন; কোনো ভয় পাবেন না। কোনো দলীয় চাপের মুখে নতি স্বীকার করবেন না- সে ধরনের লোকই আমরা চাই।'

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, 'যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তাদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে হবে। এর সঙ্গে এটাও বলেছি- যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তারা যেন সৎ, সাহসী হন এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচন উপহার দিতে পারেন। আর কমিশনে যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, সেই প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।'

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, 'আমাদের প্রত্যাশা- যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তারা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কাজ করবেন। সৎ, সাহসী ও দুর্নীতিমুক্ত হবেন এবং সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা অর্থাৎ তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে হবে। তারা যেন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হন।'

দলনিরপেক্ষ, ত্যাগী এবং সংখ্যালঘু ও নারীদের ইসি গঠনে প্রাধান্য দিতে হবে বলে কমিটিকে জানিয়েছেন গোলাম কুদ্দুছ। তিনি বলেন, সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

শাহরিয়ার কবির বলেন, 'সার্চ কমিটি মোটামুটি সব নামই প্রকাশ করবে, সেটা আমরাও বলেছি। নির্মূল কমিটির অবস্থান আপনারা জানেন। যিনি নির্বাচিত হবেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের হতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে, আমাদের সংবিধানে বিশ্বাস করতে হবে, দুর্নীতি থেকে শুরু করে তার কোনো ফৌজদারি রেকর্ড থাকতে পারবে না। এগুলো সব দেখতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে।'

তিনি বলেন, 'যে সময় দেওয়া (২৪ ফেব্রুয়ারি) হয়েছে, আমি মনে করি এমন কোনো সময়সীমা থাকা উচিত না। কারণ এটিতে সময় লাগবে। তিনশ বা চারশ যে পরিমাণ নামই আসুক, তাদের সবার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। সময়সীমার বাধ্যবাধকতার জন্য যদি অযোগ্য লোক ইসিতে এসে যায়, সেটা আমাদের কাম্য নয়।'

তিনি আরও বলেন, 'সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের আমরা এখানে দেখতে চাই। সাহসী ব্যক্তিদের দেখতে চাই। আপনাদের খুঁজতে হবে সততা। আপনাদের খুঁজতে হবে সাহস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতা। সেই ব্যক্তিদের আমরা দেখতে চাই, যার সেই মেরুদণ্ড আছে, সাহস আছে। প্রধানমন্ত্রীও যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, তাহলে তাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এই সাহসী ব্যক্তিদের আমরা নির্বাচন কমিশনে দেখতে চাই।'

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, 'অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন কমিশন চেয়েছি। সেখানে আমলাতন্ত্র ও জুডিশিয়ারি থেকে যে ধারায় কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়, সেটা বাদ দিতে বলেছি। আমরা চাই, কমিশনে সিভিল সোসাইটি এবং নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকুক।'

মফিদুল হক বলেন, আবশ্যিকভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক, তাদের নামাই ইসি গঠনে প্রস্তাবিত তালিকায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রপতি তাদের মধ্যে থেকে যোগ্যদের বাছাই করে নেবেন। আমরা চাই অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন। এ জন্য শক্তিশালী ইসি গঠন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'পরামর্শে আমি বলেছি, নামগুলো প্রকাশ করতে হবে তিনবার। এখন যে নামগুলো এসেছে, কোন দল কার নাম প্রস্তাব করেছে- এগুলো প্রকাশ করতে হবে। এ ছাড়া আইনে বলা আছে, স্বচ্ছতার সঙ্গে সুনাম অধিকারী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে। এখন প্রশ্ন হলো, এগুলোর মানদণ্ড কী? এগুলো একমাত্র নির্ণায়ক হচ্ছে, এগুলো প্রকাশ করা এবং জনশ্রুতিই একমাত্র পথ। আমাদের মতামত অনেকেই জানেন। কিন্তু আমরা জানতে চাই, কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে এবং কী মানদণ্ড অনুসরণ করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'জাতি একটা সংকটের মধ্যে আছে। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এটা জানা দরকার। যাতে আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারি।'

একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'ক্ষমতাসীন দল তাদের জোটের দলগুলো দিয়ে কতগুলো নাম প্রস্তাব করাবে। এভাবে কিন্তু তারা সমমনাদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিতে পেরেছে। আমার প্রশ্ন হলো, কীভাবে পেরেছে? তাহলে সার্চ কমিটি কী অনুসন্ধান করল?'

'আমি বলেছি, স্বচ্ছতা এবং সুনামসম্পন্ন ব্যক্তি লাগবে। মানদণ্ড চিহ্নিত করে জানাতে হবে। আর কেবল নাম প্রকাশ করলেই হবে না। কোন দল, প্রতিষ্ঠান কার নাম প্রস্তাব করল এটা আসা জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ,' বলেন সুজন সম্পাদক।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আরও কথা বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত নিমচন্দ্র ভৌমিক, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও নুজহাত চৌধুরী।

রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন। পরদিন ওই কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যার ধারাবাহিকতায় গতকাল সার্চ কমিটির তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।