‘ফুল-ফাগুনের এলো মরশুম বনে বনে লাগলো দোল,/ কুসুম-সৌখিন দখিন হাওয়ার চিত্ত গীত-উতরোল...’। বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি ছিল মানুষ, রোগে-শোকেও জর্জরিত। তবুও জীবনতো থেমে থাকে না। জীবন বহতা নদীর মতো। নদী কখনো যেমন শান্ত, কখনো খরস্রোতা। জীবনও তেমন, কখনো রঙিন কখনো ফিকে। স্রোতের অনুকূলে সাঁতার কাটা যেমন সহজ, তেমনি জীবনের রঙিন সময়ে জীবন হয়ে ওঠে উপভোগ্যও। করোনায় প্রায় ২৯ হাজার মানুষের মৃত্যু দেখেছে বাংলাদেশ। তবে সেই শোক কাটিয়ে বাঙালি আবার যেন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

নৃত-গীত-বাদ্যে জীবনকে উপভোগ করতে চায় বলেই সোমবার শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই নয়; পুরো রাজধানীজুড়ে উৎসবমুখর মানুষের যে ঢল নেমেছিল, তাদের বেশ-ভূষা, চলন-বলন সবকিছুতেই ছিল একটি বার্তা- মধুর বসন্ত এসেছে এবং মধুর মিলন ঘটাতেই যে এসেছে, তাও সত্যি। এ জন্যই একইদিনে বসন্ত বরণের পাশাপাশি ভালোবাসার দিনও উদযাপন করেছে কোটি বাংলাদেশি। 

বসন্তবরণ অনুষ্ঠানের একটি চিত্র

রাজধানীর বাসন্তি ভালোবাসাকে দিয়েছিল এক অনবদ্য রূপ। ভালোবাসা আর বসন্তের রঙের মুগ্ধতায় তরুণ-তরুণীরা ছিল মাতোয়ারা। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশাপাশি তারুণ্যের অদম্য উৎসব ছিল দেশের সবকটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বসন্তের আগমনী দিন আর ভালোবাসা দিবসে লাল-নীল, কেউবা হিমু সেজে হলুদ পাঞ্জাবি পরেই প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পার করেছে সময়। পাঞ্জাবিতে বেশি রঙিন হয়েছে ভালবাসার মানুষেরা। তরুণীরা এসেছিলেন হলদেসহ নানা রঙের শাড়ি পড়ে। কপালে টিপ, মাথায় খোঁপা, অনেকে কানে গুঁজে দিয়েছেন গোলাপ। সব মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন এক রঙিন উৎসবে মেতে উঠেছিল সকাল থেকেই। বিকেল গড়াতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, মলচত্বর, সবুজ চত্বর, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এলাকা, হাকিম চত্বর, টিএসসি, কার্জন হল সর্বত্র উৎসব-আড্ডার আমেজ বিরাজ করে।

বসন্তবরণ আর ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন চত্বরের সামনে ফুল বিক্রি করতে দেখা গেল অতিউৎসাহী কিছু শিক্ষার্থীকেও; ফুল বিক্রির মাধ্যমে যেন ভালোবাসাই ছড়াতে চান তারা। বাসন্তী-ভালোবাসা দিবসে উৎসবের আমেজে মজেছিলো রাজধানীর সর্বত্র। রবীন্দ্র সরোবরে ছিলো নানা আয়োজন। বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় ছিলো ভালোবাসা দিবসের বিশেষ আয়োজন। রাজধানীর বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে প্রেমিক যুগল ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের নিয়েও ঘুরতে এসেছিলেন অনেকে।

জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদের আয়োজন

প্রতিবছরের ন্যয় এবারও জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদের আয়োজনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে বসন্ত উৎসব। তাতে জীবনের সীমাবদ্ধ বৃত্তকে পেরিয়ে গাওয়া হলো মলয় বাতাসের গান। এ ধরায় ভোরের সূর্য্যের আলো ছড়িয়ে পড়তেই প্রথমেই বেঙ্গল মিউজিকের শিল্পীরা সমবেত এসরাজ বাদ্যযন্ত্রে পরিবেশন করেন বাসন্তি রাগ। এরপর বসন্তের আবাহন পাঠ করেন বাচিক শিল্পী আহকাম উল্লাহ। সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করেন স্বপ্নবিকাশ কলা কেন্দ্র। ফাল্গুন আর ভালোবাসার মিশ্রণে আবৃত্তি করেন বাচিক শিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাগুনের মোহনায় ততক্ষণে দর্শক সারি পরিপূর্ণ হয়েছে বসন্ত ভালোবাসা মানুষের লাল আর বাসন্তী রঙের সাজে। শিল্পীদের সঙ্গে গুণগুণিয়ে সুর ওঠে- বসন্ত জাগ্রত দ্বারে!

বসন্তবরণ অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাঝে অনুষ্ঠিত হয় বসন্তকথন পর্ব। এই পর্বে উদযাপন পরিষদের সভাপতি স্থপতি শফি উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চলতি বছর করোনাকালের বছর। তবুও বসন্ত তার কাল নিয়মে চলে এসেছে। আমরাও সকলে এই বসন্ত পালন করে সেই করোনার যাতনা দূর করতে চাই।’

সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, ‘আমরা আপনাদের নিয়ে বসন্তের অবগাহনে মেতে উঠতে চাই। বসন্তের যে রঙের ছটা, তা সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক, বর্ণিল যে আনন্দ, সেটিই আমাদের কাম্য।’

সহ-সসভাপতি কাজল দেবনাথ বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত ভাগ্যবান। পৃথিবীর কোথাও কিন্তু ষড়ঋতু নেই। আর এই ছয় ঋতুর মধ্যে বসন্ত একেবারে ঋতুরাজ। তরুণ প্রজন্মের জন্য বলতে চাই- প্রকৃতি আমাদের আসল জায়গা। আমাদের যে অর্জন তার সবকিছুই প্রকৃতির কাছ থেকে। আসুন আমরা নিজেদের প্রকৃতির মধ্যে বিলিয়ে দিই।’

বসন্তবরণ অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা

বসন্ত কথন শেষে শুরু হয় আবির মাখার পর্ব। তারপর একে একে মঞ্চে উঠে আসে বসন্তের গান, নৃত্য। তা থেকে বাদ পড়েনি আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী সংস্কৃতিও। মহামারির কারণে এ বছরের বসন্ত উৎসব সীমিত পরিসরে পালন করা হয়। আড়াই ঘণ্টার এ আয়োজনে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে সাধনা সংস্কৃতি মণ্ডল, নৃত্যম, ধ্রুপদ কলা কেন্দ্র, ভাবনা, ধৃতি নর্তনালয়, স্পন্দন, নৃত্যাক্ষ, কত্থক, ঢাক নৃত্য, নিক্কন পারফরমিং আর্ট, নবচেতনা, মুদ্রা ক্ল্যাসিক্যাল ডান্স ও পুষ্পাঞ্জলি কলাকেন্দ্রর শিল্পীরা। 

দলীয় সংগীত পরিবেশন করে সুরসপ্তক, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী ও সুরবিহার (শিশু-কিশোর)। একক সংগীত পরিবেশন করেন শামা রহমান, মহাদেব ঘোষ, অনিমা মুক্তি গমেজ, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি, মাহমুদুল হাসান, ফেরদৌসি কাকলি, নুসরাত বিনতে নুর, নবনীতা জাইদ চৌধুরী, সঞ্জয় কবিরাজ ও এস এম মেজবা।