'আজকের পর আত্মীয়স্বজন বা সামাজিক অনুষ্ঠানে নানা মানুষের সঙ্গে আপনাদের দেখা হবে। কোনো কারণে বিব্রত বোধ করবেন কিনা?' মেয়াদ পূরণের শেষ দিনে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার ঝটপট জবাব, 'মোটেই না, মোটেই না।' তার যুক্তি, 'নির্বাচনে আইন-কানুন ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির কোনো অভাব রাখিনি। আমরা নিরপেক্ষ থেকে কাজ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কাজেই কোনো বিব্রত বোধ নেই, কোনো দুর্বলতা নেই। কোনোরকম ঘাটতি নেই।'
গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন; সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এ সময় তার পাঁচ বছরের সহকর্মী নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানমও বক্তব্য দেন।
প্রায় দুই ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে তারা ভোট ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়া, আগের রাতে ভোট হওয়া, অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। কমিশনার মাহবুব তালুকদার এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন না। তিনি পৃথকভাবে নিজ কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আরেক কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিত ছিলেন।
দায়িত্ব থাকার পাঁচ বছরে 'অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন' উল্লেখ করে বিদায়ী সিইসি বলেন, তারা সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের ওপর যে দায়িত্ব ছিল, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ থাকলেও কে এম নূরুল হুদা মনে করেন, তিনি সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থেকে আইনানুগভাবে সব নির্বাচন শেষ করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে এসেছে, সবাইকে সময় দিয়েছি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা নির্বাচনে যাবে না, নির্বাচন করবে না, তাই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি, আস্থা অর্জন করতে পারিনি।'
বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে নূরুল হুদা বলেন, 'এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা।' অডিট আপত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ভুলে বা নিয়মকানুনের ভুল ব্যাখ্যায় কিংবা ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত কারণে শত শত কোটি টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে। এগুলো আবার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। এ ক্ষেত্রে কেউ দায়ী হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অতিরিক্ত খরচ হলে ফেরত দিতে হয়। বর্তমান কমিশনের যেসব বিষয়ে অডিট আপত্তি হয়েছিল, তার কিছুটা নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকিটা এখনও হয়নি।
তিনি বলেন, তাদের মেয়াদে ছয় হাজার ৬৯০টি নির্বাচনের আয়োজন করেছেন। রুটিন কাজের বাইরেও অনেক কাজ করেছেন। আইন সংস্কারের বেশ কিছু কাজ শেষ করা হয়েছে। আরপিও, বাংলায় রূপান্তরসহ অনেক বিধিমালা করা হয়েছে। ২৪ হাজার ৮৮১ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
দায়িত্ব পালনকালে শতভাগ সফল হতে পারেননি- এমন মন্তব্য করে সদ্যই সাবেক হয়ে যাওয়া এই সিইসি বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভালো হয়নি। শতভাগ সাফল্য কোনোদিন কেউ অর্জন করতে পারে না।
তিনি বলেন, আইনের দৃষ্টিতে আইনের আলোকে আমরা পরিপূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্বাচন পরিচালনা করেছি। কোথাও কোথাও ব্যত্যয় হয়েছে।
নিজেদের ব্যর্থতা সম্পর্কে কে এম নূরুল হুদা বলেন, ব্যর্থতা এককথায় বলা যাবে না। ইসির কাজ তিনটি। সংসদ নির্বাচন, ভোটার তালিকা এবং সীমানা নির্ধারণ করা। এগুলো আমরা করেছি। ব্যর্থতা হতে পারে অনেকগুলো প্রাণহানি হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, 'মোটেই সঠিক কথা নয়। নির্বাচন কমিশন নিয়ে আগেও বিতর্ক ছিল।' তিনি বলেন, এই কমিশন এতগুলো নির্বাচন করেছে। এর মধ্যে কে কোন দলের তা দেখেননি। তবে ভুলভ্রান্তি হতে পারে।
'২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ সবচেয়ে খারাপ একটি নির্বাচন'- এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কে এম নূরুল হুদা বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর বিদেশি পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক তারাও সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন- নির্বাচন সুন্দর হয়েছে। রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে যখন রেজাল্ট আসে এবং গেজেট হয়ে গেলে ইসির কোনো ক্ষমতা থাকে না। তখন আদালতে যেতে হয়।
দিনের ভোট রাতে হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আদালতে যাওয়া উচিত ছিল। ভোটের দিন তারা কোনো অভিযোগ পাননি। অনেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। মিডিয়া বা রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে তারা এ ধরনের অভিযোগ পাননি।
সংসদ নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার বিষয়ে ইসির পক্ষ থেকে কেন তদন্ত হয়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, 'এই প্রশ্নটা পুরোনো। বারবার উত্তর দিয়েছি। আবার বলি, অনেক দিন পর এ অভিযোগ। শতভাগ ভোট অস্বাভাবিক। কিন্তু এ বিষয়ে তখন ইসির কিছু করার নেই। এটি আদালতের বিষয়। সংক্ষুব্ধ কেউ আদালতের দারস্থ হলে আদালত তখন দেখতে পারেন। গেজেট হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের হাতে কিছু থাকে না, এটা আইন।'
তিনি বলেন, 'বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন অনিয়মের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাননি। পেয়েছেন সংবাদমাধ্যমে। মাহবুব তালুকদারকে বারবার বলা হয়েছে, লিখিত দেওয়ার জন্য। কীসের ভিত্তিতে নির্বাচন বন্ধ করব? আপনি একটা লিখিত দেন। মাহবুব তালুকদার রিপোর্ট দিলে আমি বাংলায় টাইপ করেছি। তখন অলরেডি ৪টা ২০ হয়ে গেছে। তখন পুরো নির্বাচন বন্ধ করার আর সুযোগ ছিল না। বরিশাল সিটি নির্বাচন খারাপ হয়েছে। কিন্তু আমরা কোনো ক্লু পাচ্ছিলাম না। লিখিত কিছু আমরা পাইনি। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। কোথাও কোথাও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে নূরুল হুদা বলেন, 'গণতন্ত্র রক্ষা করার দায়িত্ব কি আমার? গণতন্ত্র রক্ষা করার দায়িত্ব সবার। নির্বাচনের অংশীজন প্রার্থী, সমর্থক, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ইসি। ব্যর্থ হয়ে থাকলে সবার ব্যর্থতা। আর সফল হয়ে থাকলে সবার সফলতা।'
কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, জাতীয় সংসদের ভোটের দিন তারা বিভিন্ন দলীয় প্রধানদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আজকে যারা অভিযোগ করছেন এমন একটি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চমৎকার নির্বাচন হয়েছে। তবে দলটির নাম বলতে রাজি হননি তিনি। গণমাধ্যম মাঠ পর্যায়ে ছিল, পর্যবেক্ষকরা ছিলেন কেউ কোনো ধরনের অনিয়মের বার্তা তাদের দেননি বলেও দাবি করেন তিনি।