- বাংলাদেশ
- স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক কাটবে কবে
স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক কাটবে কবে
খুনের মামলার আসামি ছিলেন আমির হামজা

আমির হামজা। ছবি-সংগৃহীত
অনেকেরই মনে আছে, ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। সেবার সাহিত্যে এই পুরস্কারটি পেয়েছিলেন বব ডিলান, যার প্রতিভা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন ছিল না; প্রশ্ন উঠেছিল- গান লেখা বা গাওয়ার জন্য কাউকে সাহিত্যে পুরস্কার দেওয়া কতটুকু যুক্তিসংগত।
এবারের সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান নিয়েও তেমন বিতর্ক দেখা দিতে পারত; কিন্তু আলোচনা সে পথে এগোয়নি, এগোবার তেমন কোনো সুযোগও ছিল না। সাহিত্যে এবার এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে আমির হামজাকে, যার সাহিত্যের সঙ্গে খুব বোদ্ধা পাঠকও পরিচিত নন। বলা হচ্ছে, তিনি চারণ গায়ক। সে হিসেবেও তিনি সারাদেশে পরিচিত বলে জানা যায় না। কারণ এ দেশে এমন অনেক গায়কই আছেন, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা পরিচিতি নেই- তারপরও দেশজুড়ে আলোচিত।
তবে আমির হামজা নিজে এখন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে-অনেক আগেই তার মৃত্যু ঘটেছে। তাকে নিয়ে কোনো অশোভন মন্তব্য বা তার প্রতিভাকে নিক্তিতে তুলে ওজন করা নিশ্চয়ই কোনো সুস্থ, রুচিশীল মানুষের সাজে না। তার চারপাশের মানুষ ও শুভানুধ্যায়ী যারা ছিলেন, যারা তার কর্মের সঙ্গে পরিচিত, তাদের বিবেচনায় তিনি পুরস্কারের যোগ্য একজন সাহিত্যিক হতেই পারেন। আমাদের প্রশ্ন সেখানে নয়।
বরিশাট গ্রামে ১৯৭৮ সালে শাহাদত ফকির নামে একজন কৃষক এবং শিল্পী নামে আড়াই বছরের একটি শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি আমির হামজা। সর্বশেষ ২০০৭ সালেও স্থানীয় একটি গ্রাম্য মারামারির ঘটনায় তিনি আসামি ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
বরিশাট গ্রামের নিহত শাহাদত ফকিরের ছেলে দিয়ানত ফকির বলেন, গরুতে ক্ষেতের ফসল খাওয়ার ঘটনা নিয়ে আমির হামজার পরিবারের সঙ্গে আমাদের বিরোধ হয়। ওই বিরোধের জের ধরে আমির হামজা এবং তার ভাই রব্বানী সরদারের নেতৃত্বে আমার বাবার ওপর হামলা চালানো হয়। তারা নির্মমভাবে আমার বাবাকে কুপিয়ে খুন করে। একই সময়ে সাবান মোল্যার আড়াই বছরের শিশু শিল্পীকে সড়কির আঘাতে খুন করা হয়। এ ঘটনায় তারা দুই ভাইসহ মোট ৬ জনের কারাদণ্ড হয়। আট বছর জেল খাটার পর ১৯৯১ সালের দিকে বিএনপি সরকার গঠন করলে মাগুরার মন্ত্রী মজিদুল হকের সহায়তায় বেরিয়ে আসেন তারা।
প্রশ্ন হলো, তাহলে আমাদের দেশের পুরস্কারগুলো কোন বিবেচনায় দেওয়া হচ্ছে? পুরস্কার দেওয়ার কাঠামোটি কি সর্বজনস্বীকৃত? যদি তা গ্রহণযোগ্য একটি কাঠামো থেকেই দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক কিংবা বাংলা একাডেমির মতো পুরস্কার ঘোষণার পর অসুস্থ বিতর্ক দেখা দিচ্ছে কেন? আমির হামজাকে মৃত্যুর পরও ঘোলা জলে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে- এর দায় কার? তার বিরুদ্ধে গুরুতর যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো দেখার দায়িত্ব কার?
গর্হিত অপরাধটি আসলে তারাই করেছেন, যারা এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজকর্মেই বেশি উৎসাহী, তার ওপর মেরুদণ্ডহীন আমলা- এমন মানুষজন যদি পুরস্কারের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকেন, তা হলে কোনোদিনই সঠিক ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৭ সালে এই স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার শুরুর পর চতুর্থ বছরে, ১৯৮০ সালেই তা বিতর্কের ঝড় তোলে। সে বছর শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয় মওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে। যিনি শর্ষিনার পীর হিসেবে যেমন, তেমনি সুপরিচিত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী হিসেবে। বিভিন্ন সময় এ দেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে এই পুরস্কার বাতিলের দাবিও তোলা হয়েছে। কিন্তু তা দাবিই রয়ে গেছে। যদিও ২০২০ সালে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার পরও বিতর্কের মুখে পরে নামটি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
যে কোনো পুরস্কারকেই বিতর্কমুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপ হলো, পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়াটিকে আমলাতান্ত্রিকতার বাইরে নিয়ে আসা। বাংলাদেশে কেবল সাহিত্য পুরস্কার নয়-শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, বিচার বিভাগ, পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রতিনিয়ত বিতর্ক হচ্ছে। কেননা এসব সিদ্ধান্তও নেওয়া হচ্ছে আমলাতান্ত্রিকভাবে। বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করবেন, সুনির্দিষ্ট কাঠামোর প্রতিনিধিরা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং আমলাতন্ত্র তা বাস্তবায়ন করবে-এই ভারসাম্যমূলক প্রক্রিয়া যদি অনুসরণ করা না হয়, তা হলে পুরস্কার দেওয়া বিষয়টি ভবিষ্যতেও ব্যক্তির ইচ্ছা ও দলবাজিরই শিকার হবে।
মন্তব্য করুন