- বাংলাদেশ
- এক নিঃশ্বাসের উচ্চারণ
এক নিঃশ্বাসের উচ্চারণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাঠখোদাই মাধ্যমে করা প্রতিকৃতি শিল্পী :ফাইয়াজ হোসেন
ইংরেজ কবি মিলটনের চমৎকার একটি উক্তি আছে। যার বাংলা করলে হবে, শৈশবকাল একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষকে দেখায়, যেমন সকাল দিনকে বুঝিয়ে দেয়। কবি মিলটন অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য উচ্চারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তা তো কবির কথার মতো। শৈশবের খোকা যে একদিন বঙ্গবন্ধু-বিশ্ববন্ধু হবেন, তা খোকার শৈশব থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষ হয়ে ওঠা প্রত্যক্ষ করলেই বোঝা যাবে। মানুষটির জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত- মাত্র ৫৫ বছর চার মাস ২৯ দিন (যখন তাকে হত্যা করা হয়)। জেলখানায় কেটেছে তার তিন হাজার ৫৩ দিন; এর সঙ্গে যোগ হবে পশ্চিম পকিস্তানের কারাগারের ২৯০ দিন। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে সময় পেয়েছিলেন এক হাজার ৩১৪ দিন।
বোধগম্য, সংক্ষিপ্ত জীবনে কাজের জন্য নিরবচ্ছিন্ন কোনো সময় বঙ্গবন্ধুর হাতে ছিল না। কিন্তু আমাদের বিমুগ্ধ বিস্ময়- তার কাজের ব্যাপকতা ও স্থায়িত্ব। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। বাঙালির রাষ্ট্রীয় সত্তা অর্জনের অনুঘটক মানুষটি।
তার জন্মদিনে তাই বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ আমাদের এক নিঃশ্বাসের উচ্চারণ। তবে নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল মানুষ ছিল বলেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আজ বিশ্বজুড়ে নান্দীপাঠের বিষয়। ১৯৬৬-তে সিরাজুল আলম খান বলেছিলেন, 'শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন করতে হবে। কারণ, লোকে তার কথা শোনে।' নেতৃত্ব গবেষক মার্কিন অধ্যাপক গ্যারি উইলসও নেতৃত্ব বলতে নেতা-অনুসারীর মিথস্ট্ক্রিয়া বুঝিয়েছেন। অবিস্মরণীয় ৭ মার্চের ভাষণের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশক জ্ঞাতব্য ছিল- 'ভায়েরা আমার, আমার ওপর আপনাদের বিশ্বাস আছে?' উপস্থিত জনতা দু'হাত তুলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আমাদের ভাবনা তার নেতৃত্ব নিয়ে, যা মোটাদাগে একক হলেও অনুপুঙ্খ বিচারে অনুসারী-সমর্থন সমৃদ্ধ ছিল; আর এমন নেতৃত্বের কাছে বাংলাদেশ ও বাঙালির ঋণ।
খোকার জন্মলগ্নে তার নানা শেখ আবদুল মজিদ নাতির নামে আকিকা দিয়ে মেয়েজামাইকে বলেছিলেন, 'তোদের এই ছেলে অনেক বড় হবে।' এমন কথা গুরুজনরা সদ্যোজাতদের সম্পর্কে বলে থাকেন। কিন্তু নানা খোকা সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা তো ভবিষ্যতে ফলে গিয়েছিল; এত বড় নেতা বাঙালি কোনোদিন পায়নি। বিবিসির জরিপে তো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
১৯৪৬-এর একটি ঘটনা। স্বনামখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাস সপরিবারে থাকতেন কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায়। দাঙ্গার সময়ে কেউ বাড়ি ছিলেন না। বাড়ির সব মালপত্র লুট হয়ে যায়। ছবি বিশ্বাস পুলিশের সাহায্য না নিয়ে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের শরণাপন্ন হন। শেখ মুজিবের তৎপরতায় ছবি বিশ্বাস তার মালপত্র ফিরে পান। ছবি বিশ্বাস শেখ মুজিবের মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, 'আশীর্বাদ করি, তুমি বাঙালির বড় নেতা হও।' খোকা বাঙালির বড় নেতা হয়েছিলেন।
'কারাগারের রোজনামচা'য় ১৯৬৭-এর ১৭ মার্চ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই- বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটাতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। ...আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস।
সেদিন ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালন করেছে। জেলখানায় সহকর্মীরা যে যেভাবে পেরেছে, বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। এমনকি স্ত্রীর নেতৃত্বে ছেলেমেয়েরাও সেদিন বাবাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে (পৃ. ২০৯-২১১)। বলা যায়, '৬৭-এর জন্মদিন বঙ্গবন্ধুর জন্য ভালোই কেটেছিল।
'৭১-এর ১৭ মার্চ- উত্তাল মার্চে একজন বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে তার জন্মদিন সম্পর্কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল- 'আমার জন্মদিনই কি, মৃত্যুদিনই বা কি? বাংলার মানুষ কষ্টে আছে।'
বোঝা যায়, নিজের জন্মদিনে ঘটা করে কোনো আয়োজন হোক, তা বঙ্গবন্ধু চাননি। কিন্তু আমরা বেশ ঘটা করে তার জন্মদিন পালন করি; আমাদের দায়বোধ থেকে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আমাদের জতীয় শিশু দিবসও বটে। শিশু অন্তঃপ্রাণ বঙ্গবন্ধু বলতেন, 'শিশু হও। শিশুর মতো হাসতে শেখ। সারা দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।' বঙ্গবন্ধু সারাজীবন শিশুর সারল্যে হেসেছেন; সারা দুনিয়ার ভালোবাসা পেয়েছেন।
[লেখক :বঙ্গবন্ধু চেয়ার, অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস]
মন্তব্য করুন