- বাংলাদেশ
- জীবন-সংসার এখন 'গলার কাঁটা'
জীবন-সংসার এখন 'গলার কাঁটা'

শীর্ণ শরীরে চামড়ায় ভাঁজ। পরনে হালকা সবুজ রঙের ফিনফিনে শাড়ি। চৈত্রের তেজি দুপুরে কপাল ভিজে করছে চিকচিক। লাল সুতি ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছছিলেন বারবার। পাঁচ কেজি মোটা চালের আশায় সাতসকালেই ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) ট্রাকের সামনে হাজির। পাক্কা চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ক্লান্ত ৭০ বছরের মেহের নিগার।গতকাল বুধবার পল্লবীর ৬ নম্বর
সেকশনে মেহেরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- চাল নিতে লাইনে দাঁড়ানোর মতো বাসায় আর কেউ কি নেই। তার উত্তর, 'পোলা একটি ইশকুলে দারোয়ানগিরি করে। পোলার বউ মেলা দিন অসুস্থ। দুই নাতিও ছোট। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য আর কে আইবে। এখন যে অবস্থা, সংসার আর চলে না। সকালে সবাই পানিভাত লবণ দিয়া কছলাইয়্যা খাইছি। রাতে ২০ টাকার ইছা মাছ কিনে ভাউত্যা শাক দিয়ে রান্না হয়। অনেক দিন ধরেই হাক-পাতা খেয়ে আছি। পাঁচ কেজি চাল বাজারে কিনতে ৩০০ টাকার মতো লাগে। ট্রাক থেকে কিনলে ১৫০ টাকার মতো বেঁচে যায়। গরিবের জন্য এটা কম কীসে। গায়ে জোর থাকলে আমিও কাজ করতাম। সেই জোর তো আর নাই।'
কষ্টের কথা বলতে বলতে গড়িয়ে পড়ে মেহেরের চোখের জল। ওএমএসের ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে মেহেরের মতো আরও কয়েকটি পরিবারের জীবনযুদ্ধের গল্প শোনা গেল। তারা এসেছেন মোটা চাল ও আটা কিনতে। গতকাল ওই ট্রাক থেকে সুলভমূল্যে এ দুটি পণ্য বিক্রি করা হচ্ছিল। ট্রাকের লোকজনের কাছ থেকে কেউ কেউ আবার খবর নিয়ে গেলেন সয়াবিন তেল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনিসহ অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে কখন আসবে টিসিবির ট্রাক।
বাজারে সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ওএমএসের ট্রাকের সামনে দীর্ঘ হচ্ছে সারি। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। করোনা অনেকের জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কাজ হারিয়ে কেউ কেউ এখনও বেকার। অনেকের আবার কমেছে আয়। তবে করোনা পরিস্থিতি একটু ভালোর দিকে থাকলেও মানুষের জীবনব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি এখনও।
জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের বস্তিবাসী ও গ্রামবাসীর আয় যথাক্রমে ১৮ ও ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে বর্তমানে শহরে বস্তিবাসীর ৭৭ শতাংশ পরিবার দরিদ্র। শহরের খরচ চালাতে না পেরে গ্রামে বা তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল শহরে চলে যাওয়া ১০ শতাংশ বস্তিবাসী এখনও পুরোনো বাসস্থানে ফিরে আসেনি।
চলমান সংকট নিরসনের ব্যাপারে জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্য যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে- এ ব্যাপারে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। কিছু পণ্যমূল্য আছে, যেটা আমরা নিজেরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। চাঁদাবাজি বন্ধ ও ট্যাক্স কমাতে হবে। কিছু আছে বৈশ্বিকভাবে দাম কমা বা বাড়ার ওপর নির্ভরশীল। দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি এখনকার বড় সংকট অনেকের আয় কমে যাওয়া।
ওএমএসের ট্রাকের সামনে কথা হয় ফিরোজ রহমানের সঙ্গে। মিরপুর ২ নম্বরে পরিবার নিয়ে বাস করেন এই দর্জি শ্রমিক। ফিরোজ বলেন, 'মাসে আমার ১৫ হাজার টাকা আয়। স্ত্রী পোশাক কারখানার শ্রমিক। তারও আয় মাসে ৯ হাজার টাকা। আমাদের যৌথ পরিবার। মা, ভাই, ভাবি ও সবার ছেলেমেয়ে একসঙ্গে থাকি। আয় আগের মতোই আছে, প্রায় সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাংস কেনা এখন সাধ্যের বাইরে। কীভাবে সংসারের জিনিসপত্র কিনে দু-চার টাকা বাঁচানো যায়, মাথায় এখন সেই ভাবনা সারাক্ষণ।' তিনি বলেন, 'এত সময় অপেক্ষার পর মাত্র পাঁচ কেজি চাল, এটা দুঃখজনক। বড় সংসার, একসঙ্গে ১০ কেজি চাল পেলেও চার/পাঁচ দিন চলে যেত। এখন দু'দিন পর আবার লাইনে দাঁড়াতে হবে।'
পল্লবীর বাসিন্দা ফরিদা পারভীন শোনালেন তার সংসারের ধূসর গল্প। ছোট্ট দুই ছেলে সিরাজুল, রবিউল ও মেয়ে লামিয়া এবং স্বামীকে নিয়ে তার পরিবার। মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় বস্তিতে থাকেন। স্বামী ফারুক ভ্যানচালক। ফরিদা বলেন, 'গত বছর আগুনে বস্তির ঘর পুড়ে পরনের কাপড় ছাড়া কিছু ছিল না। এরপরও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। প্রতিদিন স্বামীও কাজ পান না। গৃহকর্মী হিসেবে আমার সামান্য আয় ও স্বামীর রোজগারে আধাপেটা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।'
বরগুনার বেতাগীর গুলবানিয়ার আছিয়া খাতুনের (৬০) কাহিনি আরও করুণ। তার রুগ্ণ শরীর। লাঠি হাতে কোনোমতে দাঁড়িয়েছেন ট্রাকের পেছনে। থাকেন পল্লবীর বস্তিতে। একমাত্র ছেলে রুহুল আমিন, তার বউ আর দুই নাতি নিয়ে তার সংসার। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। ছেলে ভাঙাড়ির দোকানে কাজ করেন। আছিয়া বলেন, 'জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, আল্লাহ কষ্ট বাড়াচ্ছে। কোনোরকম খাইয়্যা-পইর্যা আছি। টাকার অভাবে অনেক দিন দেশ-গ্রামেও যাওয়া হচ্ছে না। সামনে রোজা আইছে। রিলিফে কিছু জিনিসপত্র পেলে ভালো হতো।'
ওএমএসের ট্রাকের সামনে শাহরিয়া বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তার স্বামী সোহেল রিকশাচালক। মিরপুর ৭ নম্বরে টিনশেড বস্তিতে বাস করেন। শাহরিয়া বলেন, 'শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে বড় কষ্টে সংসার চলছে। বেশিরভাগ দিন ভাতের সঙ্গে আলুভাজি খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। মাংস কেনার কথা কল্পনাও করি না। মাঝেমধ্যে পাঙাশ আর তেলাপিয়া মাছ কেনা হয়। গরিবের কত কষ্ট, তার মধ্যে এলাকার বাড়িওয়ালাদের লোকজনও ট্রাক থেকে জিনিসপত্র কিনতে লাইনে দাঁড়ায়, এটা কেমন কথা।'
আজহার উদ্দিন গাজীপুরে একটি ডাইং কারখানায় চাকরি করতেন। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর চাকরি হারান। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গাজীপুর থেকে চলে যান গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুরের কাহুনিয়ায়। গ্রামে কোনো কাজকর্ম না পেয়ে সাত মাস আগে স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। মগবাজারের মধুবাগে পাঁচ হাজার ২০০ টাকায় একটি টিনের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছেন পরিবারের পাঁচ সদস্য। শুরুতে মধুবাগ এলাকায় আম বিক্রি শুরু করেন। আমের মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ায় তিন মাস আগে একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নেন মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে। মগবাজার এলাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের বুথে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দিনে ১২ ঘণ্টা ডিউটি। যা বেতন পান, ঘর ভাড়া পাঁচ হাজার ২০০ টাকা দেওয়ার পর আর সংসার চলে না। এরপর আছে তিন ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ। ছোট মেয়ের এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। টানাপোড়েনের সংসারে এবার এইচএসসি পাস করা বড় ছেলেকে সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি দিয়েছেন আট হাজার টাকা বেতনে। আজহার উদ্দিন বললেন, 'আমাদের কষ্টের কথা কে শুনবে ভাই। বড় সংসার আমার। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, চলা কঠিন হয়ে পড়ছে। একটা লাউ কিনতে গেলেও ৬০ থেকে ৭০ টাকা। তাই এসব খাই না এখন। আগে মাসে এক-দুবার ব্রয়লার মুরগি কিনতাম। এখন তাও পারি না। কখনও পাতলা ডালের সঙ্গে আলুভর্তা, কখনও ডিমভাজি- এসবই বেশি খাই এখন। গরুর মাংস কিনেনি ছয় মাসের বেশি হয়ে গেল।'
৫৫ বছর বয়সী শওকত আলীর চার সদস্যের সংসার। দুই মেয়ের মধ্যে বড়জন এবার এইচএসসি পাস করেছে আর ছোট মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। বঙ্গবাজার এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সাত হাজার টাকায় একটি কক্ষে ভাড়া থাকেন শওকত। হাইকোর্টের মাজারের সামনে পিঠা তৈরি করে বিক্রি করতেন। গরম পড়ে যাওয়ায় গতকাল থেকে ভ্যানে লেবুর শরবত বিক্রি শুরু করেছেন। গতকাল জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের সামনে শরবত বিক্রির সময় কথা হয় তার সঙ্গে। সংসার কেমন চলছে- এমন প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, 'নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। আর পারছি না। কষ্ট করে কত দিন চলা যায়! যা আয় করি, তা দিয়ে দুই মেয়ের পড়ালেখা, সংসার চালানো খুব কষ্ট হয়ে যায়। এখন দুই মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করা ছাড়া কোনো পথ দেখছি না।'
মগবাজারের গাবতলায় সড়কের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকান চালান নান্নু মিয়া। দিনে তার আয় পাঁচ-ছয়শ টাকা। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। থাকেন মগবাজার পেয়ারাবাগে, একটি টিনের ঘরে। ভাড়া ছয় হাজার টাকা। বড় মেয়ে নবম শ্রেণি ও ছোট মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট ছেলের বয়স এক বছর। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে আয় ও সংসার খরচ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই একটু বিরক্তবোধ করলেন। প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, 'এই ছোট্ট চা দোকান দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালিয়ে আসছিলাম। কয়েক মাসে চাল, তেল, পেঁয়াজ, তরকারির দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে সংসার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে ডাল-আলুই চলছে বাসায়। কখনও ডিমভাজি থাকে।' মাছ-মাংস প্রসঙ্গ তুললে বলেন, 'এগুলো আমার কাছে সোনার হরিণের মতো।'
হাইকোর্টের সামনে কথা হয় অটোরিকশার চালক নুর নবীর সঙ্গে। জীবন-সংসার সম্পর্কে জানতে চাইলে জানালেন, সকাল ৬টায় অটোরিকশা নিয়ে বের হন আর রাত ১২টায় বাসায় ঢোকেন। থাকেন গাবতলীর বাগবাড়ী এলাকার একটি মেসে। স্ত্রী ও তিন মেয়ে থাকে গ্রামের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর থানার মাহিয়ারপুরে। তারাও একসময় ঢাকায় ছিলেন। করোনাকালে আয় কমে যাওয়ায় গ্রামে চলে যেতে হয় তাদের। তবে করোনা কমে আসায় স্ত্রী-সন্তানদের ফের ঢাকায় আনার কথা ভাবছিলেন তিনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন জানিয়ে নুর নবী বলেন, 'তিন-চার মাস আগেও মেসভাড়া আর সকাল ও রাতে খাবার বাবদ দিনে গড়ে খরচ হতো ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। কয়েক মাস ধরে সেই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ টাকা। একার খরচই ১০০ টাকা বেড়েছে। এ জন্য পরিবারকে ঢাকায় আনার চিন্তা বাদ দিয়েছি।
রানা খান রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার এক ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রাইভেটকার চালান। বেতন ১৮ হাজার টাকা। স্ত্রী-সন্তান থাকে গ্রামের বাড়ি। তিনি থাকেন ধানমন্ডিতে একটি ভবনের দারোয়ানের কক্ষে সিট ভাগাভাগি করে। নিজেই রান্না করেন। ১৮ হাজার টাকা দিয়েই নিজের ও বাড়িতে সংসার চালাতে হয়। দ্রব্যমূল্য বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। খরচ কমাতে ডিমভাজি-ভাত এখন তার প্রিয় খাবার। তারপরও প্রতি মাসে স্ত্রীকে টাকা পাঠানোর সময় লাগে টানাটানি। কারণ যে টাকা পাঠান, তা দিয়ে সন্তানদের চাহিদা পূরণ করতে পারেন না তার স্ত্রী। রানা বলেন, 'স্ত্রীর বিষয়টিও বুঝি। সে রাগ তো করবেই। ছেলেমেয়েরা মাছ-মাংস খেতে চাইলে ঠিকমতো কিনতে পারে না। তাকে বলি, মনে করো, আমাদের মতো গরিব মানুষ বেঁচে আছি- এটাই বড় সান্ত্বনা।'
মন্তব্য করুন