ভবন নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রড। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বাজারে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে অন্তত ১৬ হাজার টাকা। দাম বাড়ার এই প্রতিযোগিতায় একই পথে দৌড়াচ্ছে সিমেন্ট, ইট, বালু, টাইলস, স্যানিটারি উপকরণ, পাথর, গ্লাসসহ ভবন নির্মাণের প্রায় প্রতিটি সামগ্রী। নির্মাণ খরচ বেশি হওয়ায় ফ্ল্যাটের দামও চড়েছে। ফলে অনেক মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট কেনার যে স্বপ্ন এত দিন মনে এঁকেছিলেন, তা হয়ে যাচ্ছে ফিকে। জমি আছে, তবে সেই খালি জমিতে অনেক মধ্যবিত্তের বাড়ি তৈরির বাসনা উবে যাচ্ছে নির্মাণসামগ্রীর দরের চোখ রাঙানিতে। সবকিছু মিলিয়ে খাদের কিনারায় আবাসন খাত। নির্মাণসামগ্রীর দরের এই জাঁতাকলে পড়ে সরকারের চলমান উন্নয়নমূলক কাজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; বাড়-বাড়ন্ত হচ্ছে প্রকল্পের খরচ।

নির্মাণসামগ্রীর উৎপাদকরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে রড-সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল, জাহাজ ভাড়া ও ডলারের দাম চড়া থাকায় বেড়েছে উৎপাদন খরচ। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচও বেড়েছে। এ কারণেই লাগামছাড়া নির্মাণসামগ্রীর দাম।

তবে আবাসন খাতের ব্যবসায়ী ও ভোক্তা অধিকার-সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ, যুদ্ধের ছুতায় উৎপাদনকারীরা সিন্ডিকেট করে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়াচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক তথ্য দিয়ে দফায় দফায় পণ্যের দাম বাড়ালেও সরকার কার্যত নির্বিকার। তাদের পরামর্শ, গুটিকয়েক কোম্পানির স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে সরকারের উচিত আমদানি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাই করা। একই সঙ্গে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দর বাড়ার কারণও তদারকি করা।

রড উৎপাদনকারীদের তথ্যমতে, বাজারে বর্তমানে পাওয়া যায় তিন ধরনের এমএস রড। অটো কারখানায় তৈরি ৭৫ গ্রেডের (৫০০ টিএমটি) রডের মান সবচেয়ে ভালো। এ ছাড়া রয়েছে সেমি অটো কারখানায় তৈরি ৬০ গ্রেড (৫০০ ওয়াট) এবং সাধারণ বা ৪০ গ্রেডের রড। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভালো মানের রডের মধ্যে বিএসআরএমের ৭৫ গ্রেডের প্রতি টন রড খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৯২ হাজার টাকায়।

একই গ্রেডের কেএসআরএম, আরএসএম, বন্দর স্টিল, জিপিএইচসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রড বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯১ হাজার টাকায়। তিন সপ্তাহ আগেও এসব ব্র্যান্ডের রডের দাম ছিল ৭৬ থেকে ৭৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে দাম বেড়েছে ১৩ থেকে ১৬ হাজার টাকা। সেমি অটো মিলের ৬০ গ্রেডের (৫০০ ওয়াট) রডের দামও এখন ৮০ হাজার টাকার বেশি। তবে বছর দুয়েক আগেও প্রতি টনের দাম ছিল গড়ে ৬৪ হাজার টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে অন্তত ২৮ হাজার টাকা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের 'খান ট্রেডার্স' কয়েকটি কোম্পানির রড ও সিমেন্টের ডিলার। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির মালিক উজ্জ্বল খান বলেন, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চট্টগ্রামের রডের দাম। কারণ, ভালো মানের রড বেশি উৎপাদন হয় সেখানে। সিমেন্টের দর বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

রড উৎপাদনকারীরা জানান, রডের প্রধান কাঁচামাল স্ট্ক্র্যাপের দাম বিশ্ববাজারে বাড়তির দিকে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে স্ট্ক্র্যাপ সরবরাহে সংকট এবং জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়া ও সরবরাহে সময় বেশি লাগার কারণে রডের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সিনিয়র সহসভাপতি ও বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হুসাইন বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ লাগার পর কখন কী হয়- আশঙ্কা থেকে বিশ্বের সব দেশই স্ট্ক্র্যাপের আমদানি বাড়িয়েছে। বিশ্ববাজারে স্ট্ক্র্যাপের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে। পাঁচ থেকে ছয় মাস আগেও প্রতি টন স্ট্ক্র্যাপের জাহাজ ভাড়াবাবদ খরচ পড়ত ৩০ থেকে ৪০ ডলার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ থেকে ১২০ ডলারে।

রহিম স্টিল মিলের জিএম সফিকুল ইসলাম বলেন, এত দিন রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশসহ এ অঞ্চল এবং তুরস্কের স্ট্ক্র্যাপের দাম তুলনামূলক কম ছিল। যুদ্ধের কারণে এসব দেশ থেকে স্ট্ক্র্যাপ সরবরাহ কমে গেছে, দামও বেড়েছে। এক থেকে দেড় মাস আগেও প্রতি টন স্ট্ক্র্যাপের দাম ছিল ৫৩০ থেকে ৫৪০ ডলার, এখন বেড়ে হয়েছে ৬৩০ থেকে ৬৭০ ডলার। ইস্পাত তৈরির কাঁচামাল বিলেট ও প্লেটের দামও চড়ে আছে। অন্যদিকে, দেশে ক্রেতাদের চাহিদাও অস্বাভাবিক বেড়েছে। কারও ১০০ টন রড প্রয়োজন হলে তিনি কিনছেন তিন গুণ। দাম আরও বাড়তে পারে- এই শঙ্কা থেকে বেশি করে কেনার প্রবণতা। যৌক্তিক কারণের বাইরে চাহিদার চাপেও রডের দাম বেড়েই চলেছে।

এদিকে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রডের সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। অনেক ব্যবসায়ী জানান, উৎপাদনকারীরা রডের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে ক্রেতারা চাহিদামতো পণ্যটি পাচ্ছেন না।

রডের সঙ্গে বাড়ছে সিমেন্টের দামও। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। বাজারে শাহ সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫১০ টাকায়, যা ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে ছিল ৪৬০ থেকে ৪৭০ টাকা। স্ক্যান সিমেন্ট ৪৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৯০-৫০০ টাকা, ফ্রেশ ৪৫০ থেকে বেড়ে ৪৯০, সেভেন রিং ৪৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, সিমেন্ট তৈরিতে ক্লিঙ্কার, জিপসাম, স্ল্যাগ, চুনাপাথর ও ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার করা হয়। এগুলো আমদানি করা হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। সংগঠনটির নির্বাহী সদস্য ও ডায়মন্ড সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল খালেক পারভেজ বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে এসব কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এ কারণে সিমেন্টের দামেও প্রভাব পড়েছে।

ভবন তৈরির অন্যতম কাঁচামাল ইট আমদানি করতে হয় না। তবুও দাম বাড়ছে। মাসখানেক আগে ভালো মানের প্রতি পিস ইটের দাম ছিল ১০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ থেকে সাড়ে ১১ টাকায়। ইট উৎপাদনকারীদের অভিযোগ, কয়লার দাম বাড়ার কারণে ইটের দাম বাড়ছে। বড় কোম্পানিগুলো এখন সিমেন্ট আর ইটের ব্যবসায় নেমেছে। এ কারণে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এক বছর ধরে কয়লা আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে কয়লার দাম বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।

বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ও রাজা অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মোনিয়াম খান বলেন, হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি কয়লা আমদানি করছে। তারা মর্জিমতো কয়লার দাম বাড়াচ্ছে। এ কারণে ইটের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে দাম বেশি নিতে হচ্ছে। দাম বাড়ার তালিকায় আছে বালু-পাথরও। ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে প্রতি বর্গফুট লাল বালু ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ টাকা বেড়ে সাদা বালু বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ টাকায়। ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক যুগের মধ্যে পাথরের দাম এখন সর্বোচ্চ। দুই মাস আগে প্রতি বর্গফুট পাথর পাওয়া যেত ১৮৫ থেকে ২০৫ টাকায়। এখন দাম ২৩৫ থেকে ২৫০ টাকা।

ভবন তৈরির পর দরকার হয় গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, হার্ডওয়্যার জাতীয় পণ্য। বাজারে এসব পণ্যের দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী। রাজধানীর তেজতুরীপাড়া এলাকার 'লাকি গ্লাস অ্যান্ড থাই'য়ের স্বত্বাধিকারী রাশেদুল আলম বুলু বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে পাঁচ মিলিমিটার পরিমাপের সাদা গ্লাস প্রতি বর্গফুটে সাত টাকা ও রঙিন গ্লাসে ১২ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। থাই অ্যালুমিনিয়ামে প্রতি ফুটে বেড়েছে ২৭ টাকা। হার্ডওয়্যার জাতীয় পণ্যের প্রতি পিসে বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। তবে হার্ডওয়্যার জাতীয় এসব পণ্য বেশিরভাগই আসে চীন থেকে। তাই দাম প্রায়ই ওঠানামা করে।

তবে ভোক্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারের বাড়তি দামে কেনা কাঁচামাল এখনও দেশে আসেনি। ব্যবসায়ীরা খোঁড়া যুক্তিতে রডের দাম বাড়াচ্ছেন। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে দুশ্চিন্তা বাড়ছে আবাসন খাতে। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) বলছে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় আবাসন শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতে স্থবিরতা নেমে আসবে বিভিন্ন সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে চলমান কাজেও। সংগঠনটি দাবি করছে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে প্রতি বর্গফুটে তাদের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ৭৪০ থেকে ৮০০ টাকা। রিহ্যাব নেতারা বলছেন, দাম বাড়ার কারণে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ ও হস্তান্তর প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন ফ্ল্যাট বিক্রিও কমেছে।

সংগঠনটির সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম কেন বাড়ছে, তা স্পষ্ট নয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছে সপ্তাহ তিনেক আগে। যুদ্ধ লাগার আগে যেসব এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে এবং যেগুলো যুদ্ধের আগে আমদানি করে মজুত করা হয়েছে, সেগুলোর দামও বেশি নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তদারকি করতে পারে।

ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় নিজ উদ্যোগে একটি বাড়ি নির্মাণ করছেন আজাদ হোসেন। তিনি সমকালকে বলেন, বাজারে রড, সিমেন্ট, টাইলসসহ সব জিনিসের দাম বাড়ছে। ফলে বাড়ির কাজ শেষ করতে আরও বেশি টাকার প্রয়োজন হচ্ছে। তাই পাঁচতলা বাড়ি করার পরিকল্পনা থাকলেও তিনতলা শেষ করার পর কাজ স্থগিত রাখতে হচ্ছে।

যুদ্ধের কারণে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার যুক্তিকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে করেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল। অযৌক্তিক অকাট্য তথ্য দিয়ে দিয়ে একের পর এক পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সরকার কখনোই কোনো খাতের ব্যবসায়ীদের ডেকে দাম বাড়ানোর কারণ জানতে চায় না। ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব না থাকলে ভোক্তারা সারাজীবন ঠকেই যাবেন।