
১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রত্যন্ত জনপদ সুনামগঞ্জের শাল্লার অসহায় মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা দিয়ে যে প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি আজ পত্রে-পুষ্পে পল্লবিত, বিশাল মহিরুহ। ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বপথে। পঞ্চাশ পেরিয়ে আজ তাদের লক্ষ্য আরও বহুদূর। হ্যাঁ, আজ ২১ মার্চ, স্যার ফজলে হাসান আবেদ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সুবর্ণজয়ন্তী।
সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণে ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ব্র্যাক সেই প্রথম লগ্ন থেকেই চেষ্টা করেছে প্রাসঙ্গিক থাকতে- মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে, চলমান পরিবর্তনের সঙ্গে, পরিবর্তনশীল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে। আগামীতে কার্যকরভাবে প্রাসঙ্গিক থাকাই হবে মূল লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অন্য অঞ্চলেও; যেখানে ভাগ্যপীড়িত নারী-পুরুষ ও শিশুর প্রয়োজন মেটানোর তাগাদা রয়েছে, সেখানে কাজ করবে ব্র্যাক। শুধু প্রাসঙ্গিকতা নয়, কার্যকর সমাধান এবং উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা এ দুইয়েও মনোযোগ অবিচল থাকবে।
১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ চলছিল। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফজলে হাসান আবেদ স্বাধীনতার আগে বিদেশি একটি সংস্থায় চাকরি করতেন। কিন্তু সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী দুর্যোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষের যে দুর্ভোগ হয়, তা দেখে নিজ থেকে কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন।
প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি বা ব্র্যাক। নিজের বাড়ি বিক্রির ১৬ হাজার পাউন্ড আর কয়েকজন বন্ধুর দেওয়া টাকা দিয়ে শুরু হয় কার্যক্রম।
১৯৭৩ সালে যখন পুরোদস্তুর উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক কার্যক্রম শুরু করে, তখন তার নামের বিস্তারিত পরিবর্তন এনে রাখা হয় বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি। তবে সংক্ষিপ্ত নাম ব্র্যাকই থাকে।
সে সময় ব্র্যাকের সাত সদস্যের গভর্নিং বোর্ড তৈরি করা হয়। কবি সুফিয়া কামাল হন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারপারসন, নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
তখন ভারত থেকে স্বদেশে ফিরে আসা শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ করত সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠাতার মূলমন্ত্র ছিল- যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি তার কাছেই কার্যকর সমাধানকে নিয়ে যেতে হবে। এভাবেই প্রত্যেক মানুষ পাবে তার সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশের সুযোগ। এই দর্শনকেই সঙ্গী করে পথ চলছে ব্র্যাক।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, গবেষক ও লেখক ড. আকবর আলি খান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে উদ্দেশ্য, সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিশাল ভূমিকা রেখেছে ব্র্যাক। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সেই লক্ষ্যে ৫০ বছর ধরে স্যার ফজলে হাসান আবেদের নেতৃত্বে ব্র্যাক নিরলস পরিশ্রম করে গেছে। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য নিরসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে ব্র্যাকই প্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রেখেছে। বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার ১০টি দেশের ১০ কোটিরও বেশি মানুষের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে আত্মনির্ভরতা অর্জনে কাজ করে চলেছে ব্র্যাক।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ- যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন মানুষের কাছে পৌঁছানোর, মানুষের জন্য কাজ করার। তার সেই কাজ ব্যপ্তি পেয়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। নারীর অধিকার থেকে শুরু করে শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, এমনকি উদ্যোক্তা পর্যায়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে ব্র্যাক আজ পৃথিবীর বৃহত্তম এনজিও। ভূমিকম্পবিধ্বস্ত হাইতি বা তানজানিয়ায় যেখানে মানুষের সহযোগিতার দরকার আছে, ব্র্যাক হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা 'সাউথ সাউথ' সহযোগিতার কথা বলি, ব্র্যাক তার অন্যতম মডেল। দেশের জন্য সুনাম কুড়িয়ে আনছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে।
অসংখ্য সাফল্যে গাথা মালায় উদ্ভাসিত ব্র্যাকের বহুবিস্তৃত পদচারণা। ব্র্যাকের প্রথম প্রকল্পে ফিরে আসা শরণার্থীদের জন্য শাল্লায় ১০ হাজার ২০০ বাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি জীবিকা সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ১৫ হাজার শিশু ও নারীকে খাদ্যের জোগান দেওয়া হয়। কিছুদিন পর সমবায়, কৃষি উন্নয়ন, বয়স্ক শিক্ষা, পুষ্টি, কুটিরশিল্পকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারপর শুরু ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ং। আশির দশকে দেশের প্রতিটি পরিবারে মায়েদের খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করতে শেখায় ব্র্যাকের মাঠকর্মী বাহিনী। এরপর প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশে ব্র্যাকের মাধ্যমে টিকা দেওয়া হয়। এ দুই পদক্ষেপে নাটকীয়ভাবে শিশুমৃত্যু হ্রাস পায়।
আশির দশকে ঝরে পড়া শিশুদের জন্য স্কুলের পাইলট প্রকল্প শুরু করে ব্র্যাক। পরবর্তীকালে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। আজ পর্যন্ত ব্র্যাকের স্টু্কলগুলো থেকে এক কোটি ৪০ লাখ শিশু মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পরবর্তী ধাপে এগিয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে প্রসারিত হয় নারীর সামাজিক ও আইনি ক্ষমতায়নের কাজ। ব্র্যাক ডেইরির জন্ম এই সময়ে। ইন্টারনেট সার্ভিস দিতে ব্র্যাকনেট ও সফটওয়্যার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ব্র্যাক।
নতুন শতাব্দীর শুরুতে এসডিজি লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে ব্র্যাক। সারাদেশে ৬৪ হাজার স্টু্কল ও আট হাজার কিশোরী ক্লাব পরিচালনার পাশাপাশি ২৪৮ উপজেলায় স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন করে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্র্যাক ব্যাংক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। পরের বছরই জন্ম নেয় ব্র্যাকের বিশ্বখ্যাত আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম। একই সময় ব্র্যাকের মডেল বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে যাত্রা শুরু করে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল।
বর্তমানে নগর দারিদ্র্য নিরসন এবং যুব জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষভাবে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। স্মরণকালে দেশের সবচেয়ে বড় সংকট রোহিঙ্গা ও কভিড-১৯ সংকটে সরকারের বৃহত্তম দেশীয় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে এই সংস্থা। সরকারের আর্থসামাজিক নীতি-কৌশল প্রণয়ন প্রক্রিয়াতেও আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়েছে।
ব্র্যাকের সব কর্মসূচি, কার্যক্রম ও মডেল, সর্বোপরি ব্র্যাক ব্র্যান্ডিংই গড়ে উঠেছে নারীর ক্ষমতায়নকে কেন্দ্র করে। নারীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশে নিরন্তর কাজ করে চলেছে।
একজন স্বপ্নবান মানুষ স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরে এতটা পথ এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিস্ময় জাগে, যখন তার অবর্তমানে কোনো ধাক্কা বা ঝাঁকুনি নয়, একইভাবে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। যার মূলমন্ত্র, প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। অতীতের মতো বর্তমান ও ভবিষ্যতেও নিজের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে ব্র্যাক।
৫০ বছরপূর্তিতে আজ সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সেলিব্রেটি হলে ব্র্যাক আনুষ্ঠানিক উদযাপনের আয়োজন করেছে।
মন্তব্য করুন