অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে আজ মঙ্গলবার ৪০ বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে সংলাপ করতে চলেছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এদিকে বিশ্নেষকরা বলছেন, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইসি গতানুগতিক সংলাপ অনুষ্ঠানের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০০৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত চারটি কমিশন সংলাপের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ ও পদ্ধতি বের করার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এ সংলাপেও কোনো সুফল আসবে না বলে মনে করছেন বিশ্নেষকরা। কারণ এর আগেও নাগরিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিধিরা ইসির সঙ্গে সংলাপ করেছেন এবং সুপারিশও দিয়েছেন, যা কোনো কাজে আসেনি।

এর ফলে সংলাপে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিশিষ্টজনের আগ্রহও কমে যাচ্ছে। যেমন, গত ১৩ মার্চের সংলাপে বর্তমান কমিশন ৩০ জন শিক্ষাবিদকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু অংশ নিয়েছেন মাত্র ১৩ জন। আজকের বৈঠকেও অধিকাংশ আমন্ত্রিত অংশ নেবেন না বলে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের ধারণা।
২০০৭ সালের এক-এগারোর পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়িত্ব পাওয়া সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রথম সংলাপ করে। তখন বিএনপির সংস্কারপন্থিরা সংলাপে অংশ নিলেও আরেক অংশ বর্জন করে।

এরপর নির্বাচনী আইনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এ সংলাপের সুপারিশের আলোকেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথাসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। তখন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করে ইসির কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়। পরে নতুন সংসদ গঠিত হলেও ইসির সুপারিশ কোনো কাজে আসেনি। বরং ওই সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করা হয়।

হুদা কমিশনের সংলাপে আওয়ামী লীগ দু'দফায় অংশ নিলেও বিএনপির কোন পক্ষ ইসির আমন্ত্রণ পাবে, তা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে আইনি লড়াই আদালত পর্যন্ত গড়ায়। রিট মামলা নিষ্পত্তির পর ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল বিএনপির একাংশের সঙ্গে সংলাপ হয়। এরপর কাজী রকিব কমিশনের (২০১২-২০১৭) পক্ষ থেকে সংলাপের আয়োজন করা হলেও তাতে অংশ নেয়নি বিএনপি। ওই সংলাপের উল্লেখযোগ্য কোনো সুপারিশও সরকারের কাছে তুলে ধরেনি রকিব কমিশন।

এরপর সদ্যবিদায়ী কে এম নূরুল হুদা কমিশনের (২০১৭-২০২২) পক্ষ থেকে আয়োজিত সংলাপে বিএনপি অংশ নেয়। তাদের পক্ষ থেকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অন্তত পাঁচটি ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়। যদিও এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংসদের সম্মতির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তৎকালীন সিইসি কে এম নূরুল হুদা এ প্রস্তাবের বিষয়ে বলেন, 'আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে ইসি কাজ করবে। রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনের দায়িত্ব ইসির নয়, সরকারের।'

এবারেও কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন গত মাসের শেষ সপ্তাহে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দিনেই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। তাহলে চলমান সংলাপে ইসির প্রত্যাশ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সমকালকে বলেন, 'নির্বাচনের এখনও অনেক বাকি। সমঝোতা যে হবে না, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।'

রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে আশাবাদ জানিয়ে কাজী হাবিবুল বলেন, এই সংলাপের পরে তারা নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করবেন। এরপর আবারও তাদের সঙ্গে বসা হবে। সংলাপে যারা আসছেন তাদের সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। এটা সবাইকে নির্বাচনমুখী করতে প্রভাবিত করবে। আগের কমিশনগুলোর সুপারিশ অবশ্যই পর্যালোচনা করা হবে এবং সেখান থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ বর্তমান কমিশন নেবে।

এদিকে বিশ্নেষকরা বলছেন, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ না কমলে বা সমঝোতা না হলে ইসির সংলাপ থেকে সুফল বের করা দুরূহ। বর্তমান জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রয়েছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও তাতে কার্যকর কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। তাই আওয়ামী লীগ রাজি না হলে ইসির পক্ষে প্রয়োজনীয় আইনের সংশোধন সম্ভব হবে না। যদিও সংলাপের মধ্য দিয়ে আসা সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নে একাধিক নির্বাচনী আইনের সংশোধনের প্রয়োজন। আর আইন পরিবর্তন করলেও তা করতে হবে বর্তমান সংসদে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, অতীতে একাধিক সংলাপ হলেও রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় কোনো ফল আসেনি। সংলাপে আসা সুপারিশ অনুযায়ী যে কোনো ধরনের নির্বাচনী আইন পরিবর্তন করতে হলে সংসদে যেতেই হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এই সংলাপে এজেন্ডা নির্ধারিত নয়। রাজনৈতিক সমঝোতা ইসির কাজ নয়। এই ক্ষমতা সংবিধান ইসিকে দেয়নি। সংবিধান ইসিকে যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে তার মধ্য থেকে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের কাজ করা যেতে পারে, সে বিষয়ে কথা বলতেই এই সাবেক সচিব সংলাপে যোগ দিচ্ছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান কমিশনের প্রধান কাজ জনগণের আস্থা অর্জন করা। এই কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর আগের কমিশনের সংলাপের সুপারিশ এবং তারা কেন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলো এগুলো পর্যালোচনা করতে পারত। এসবের ভিত্তিতে রোডম্যাপ নির্ধারণ করে সংলাপে বসলে ফলপ্রসূ হতো।

রকিব কমিশনের সংলাপের সুপারিশ : ২০১৪ সালে নির্বাচনকে সামনে রেখে সংলাপের উদ্যোগ নেয় কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলগুলো এতে অংশ না নিলেও সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংলাপে বেশকিছু সুপারিশ পাওয়া যায়।

ওই সময় গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপে বসতে ইসিকে পরামর্শ দিয়েছিল। তবে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিরোধ বাড়তে শুরু করলে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন থেকে পিছু হটে তৎকালীন ইসি।

নূরুল হুদা কমিশনের সুপারিশ : এই সংলাপে ৪০টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ৫৩১টি সুপারিশ পায় ইসি। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দলগুলোর স্পষ্ট বিভাজন ফুটে ওঠে।

এই সংলাপে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ও নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে পরস্পরবিরোধী সুপারিশ করে প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসির এখতিয়ারের মধ্যে থাকা অভিন্ন সুপারিশই ছিল বেশি।