আমি যদি ১০০ বছরও বাঁচি তাহলেও এই রক্তাক্ত স্মৃতি মন থেকে মুছে যাবে না। হাজার ভালো ভালো কথা, গান, ভালোবাসাতেও নয়। কীভাবে সেটা সম্ভব? আমি তখন ভাগ্য বিড়ম্বনায় পাকিস্তানের সামরিক অফিসার। আর্মির ডাক্তার হিসেবে আমার চাকরি হয়েছে। তখন ১৯৬৭ সাল। ঘোর পাকিস্তান আমল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে আমরা বেশ কয়েকজন ক্লাসমেট আর্মি মেডিকেল কোরে চাকরি নিয়েছিলাম। ভালো রেশন, ভালো মাইনে এবং ফ্রি বাসস্থানের লোভে। তার ওপর আছে আর্মির পোজপাজ। চাকরির প্রারম্ভেও আমরা হাতে একগাদা টাকা পেলাম। যেন বোনাস হিসেবে। কিন্তু ঘটনা হলো- আমরাও চাকরি নিলাম আর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানও ক্রমাগতভাবে অস্থির হয়ে উঠতে লাগল। হরতাল, মিছিল, মিটিং। প্রকৃতিও অস্থির হয়ে উঠতে লাগল। ঘূর্ণিঝড়, প্লাবন, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু। এ রকম হতে হতে শুরু হয়ে গেল দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থান, তারপর ৭০-এর নির্বাচন এবং বঙ্গবন্ধুর ল্যান্ডস্লাইড মেজরিটি পাওয়ার পরও ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র। ৭ মার্চের ভাষণে আমি আমার গায়ের ইউনিফর্মের তোয়াক্কা না করে আমার স্বামীর সঙ্গে হাজির হলাম রেসকোর্সের মাঠে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনব বলে। ভাষণ শুনলাম। শুনে গায়ের লোম যেন খাড়া হয়ে গেল। উৎসাহে, উদ্দীপনায় টগবগ করতে করতে ঘরে ফিরে এলাম। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। একটু যেন হতবুদ্ধিও। এরপর কী হবে? আমার কবি স্বামী গত ফেব্রুয়ারি মাসেই ২১ তারিখে ইয়হিয়ার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমির মাঠে মাথা উঁচু করে কবিতা পড়ে এসেছেন। আমরা ছিলাম তরুণ, না জানি কতখানিই অবোধ ছিলাম! যে মিলিটারি ক্রমশ আমাদের শত্রু হয়ে উঠছে, তারই অধীনে আমার চাকরি আর আমার স্বামী একজন আলাভোলা কবি হিসেবে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে কবিতা পড়ছেন বাংলা একাডেমির উন্মুক্ত মঞ্চে! এ রকম মূর্খতা আর কাকে বলে! তবু তখন পর্যন্ত বুঝিনি যে আমরা সাপের ল্যাজা দিয়ে কান খোঁচাচ্ছি! টের পেলাম ২৫ মার্চের রাতে। সেদিন যখন আমি এয়ারফোর্সের মেডিকেল উইং থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলাম, আমার গাড়ির সামনে ছিল একটা মিলিটারি কনভয়। ত্রিপল ঢাকা গাড়ির পেছন দিকটা খোলা ছিল। আর সেই খোলা অংশটাতে সার দিয়ে বসে ছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা। একটা সৈন্যের মুখ এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। অল্পবয়সী একটি ছেলে নির্বিকার মুখে রাস্তার পেছন দিকে গাড়িতে বসে চলে যাচ্ছে। তার হাতে ধরা অস্ত্র। যেহেতু এ রকম চিত্র মাঝে মাঝেই মার্চের প্রথম থেকে চোখে দেখতাম, তাই ২৫ তারিখে সে দৃশ্য খুব একটা মনে দাগ কাটেনি।

সেদিন বাড়ি ফেরার পরপরই আমার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর চলে এল। জীবনে আমার জ্বরজারি খুব কম হয়, সেদিন যেন খামোখা আমার শরীরে ধুমসে জ্বর চলে এল। স্বামী বাড়িতে ছিলেন। তিনি তখন বেশি বাইরে যেতেন না। আমাকে বললেন বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকতে। তারপর কীভাবে সময় কেটেছে আমার খেয়াল নেই। রাতে কিছু খেয়েছিলাম কিনা তাও স্মরণে নেই। শুধু মনে আছে হঠাৎ করে বন্দুকের গুলির শব্দে ঘুমের আচ্ছন্নতা কেটে গিয়ে চিৎকার বলে উঠে বলেছিলাম, কে আমাকে এভাবে বিরক্ত করে?

আর আমার স্বামী ভয় পেয়ে বলেছিলেন, চুপ করো, বাইরে গোলাবৃষ্টি হচ্ছে। তার কথা শুনে আমি যেন মহা বিরক্ত হয়ে বারবার বিছানা ছেড়ে বাইরে যেতে চাচ্ছিলাম, দোতলার রেলিঙে দাঁড়িয়ে দেখব- কী হচ্ছে বাইরে? কিন্তু পরিবারের অন্য লোকজনও আমাকে ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বলেছিল। আমি যদি তাদের কথা না মেনে জোর করে বাইরে বেরোতাম তো আমার কপালে সেদিন নির্ঘাত মৃত্যু লেখা ছিল। আমি ছেলেবেলা থেকে একরোখা ছিলাম। যে জন্য জীবনে আমাকে বহু বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেদিন যদি আমার জ্বর না হতো, অবশ্যই আমি তো মরতামই, আমার পরিবারও সেই সঙ্গে মৃত্যু বরণ করত। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, এই যে সেই একদিন মাত্র, বলতে গেলে এক রাত মাত্র আমার জ্বর হয়েছিল, তারপর এত দীর্ঘ দিনের জীবনে, কী দেশ বা কী বিদেশ, কোনোদিন আমার গায়ে কোনো জ্বর ওঠেনি! এমনকি তিন-তিনটে করোনা ইনজেকশন দেওয়ার পরও নয়। এই রহস্য আমি আজও ভেদ করতে পারিনি। একমাত্র সৃষ্টিকর্তার অসীম অনুগ্রহ ছাড়া হয়তো এটা আর কোনোভাবে বিশ্নেষণ করা যাবে না। সেদিন রাতে যখন স্বামী আমাকে সর্বক্ষণ দেখে রেখেছিলেন; বাচ্চারা ভয় পেয়ে চুপ করে গিয়েছিল। আমার ছোট বাচ্চাটার বয়স ছিল মাত্রই ১১ মাস। আর বড়টার বয়স ছিল তিন বছরের একটু বেশি। বাড়িতে আমার ছোট বোন ছিলেন, ছোট ননদ এবং ভাই ছিলেন। সকলেই ভয়ে আতঙ্কে চুপ, সমস্ত পাড়া চুপ। রাতে একবার জয় বাংলা ধ্বনি শুনেছিলাম গ্রিন রোডের রাস্তার ওপার থেকে। কিন্তু সেই মাত্র একবার। তার পরপরই আগুন জ্বলে উঠেছিল রাইফেল স্কোয়ারের দিকে। আগুনের লেলিহান শিখায় উজ্জ্বল টকটকে হয়ে উঠেছিল আকাশ। জানালার কাচের ফাঁক দিয়ে সেই দৃশ্য স্বামী আমাকে দেখালেন। সেই রাতে তাকে আমি খুব অস্থির দেখেছিলাম। বারবার করে বলছিলেন, মঞ্জু, আমাদের সব শেষ হয়ে গেল, সব শেষ। হয়তো আমাদের বঙ্গবন্ধুকেও এতক্ষণে মেরে ফেলেছে! তখনও হতভাগ্য আমরা জানতাম না যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেনি। মারতে পারেনি, মেরে ফেলতে সাহস হয়নি। সেই কাজ সমাধা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নিজের দেশের ছেলেদের হাতে! ভবিষ্যৎ কে আগে দেখতে পায়?

২৬ মার্চ পুরোটা দিন ছিল হরতাল। ২৭ মার্চ আর্মি থেকে নির্দেশ এল সামরিক অফিসারদের নিজের নিজের স্কোয়াড্রনে গিয়ে হাজিরা দিতে। আমি অনেক ভাবনাচিন্তা করে, স্বামী এবং আত্মীয়দের সান্ত্ব্বনা দিয়ে, কচি বাচ্চা দুটোর মুখ চুম্বন করে স্বামীর দিকে করুণ চোখে একবার তাকিয়ে একটা রিকশা জোগাড় করে কোনোমতে এয়ারফোর্স স্কোয়াড্রনের শাহীন স্কুলের মাঠে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে সকল সামরিক এয়ারফোর্স আফিসারকে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্য বিড়ম্বনায় সেখানে আমিই একমাত্র মহিলা অফিসার। আর সকলেই পুরুষ। তাকিয়ে দেখলাম সেখানে একটা স্টেজের মতো করা হয়েছে। সেই স্টেজের ওপরে বসে আছে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের স্টেশন কমান্ডার, তার সঙ্গে আরও কয়েকজন পাকিস্তানি অফিসার, এবং আমাদের এ কে খন্দকার স্যার। সেই স্টেজেই স্যারের সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা। তার পরদিনই বা কয়েকদিন পর মনে হয় স্যার তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। আরও অনেকে সেইদিন সেই সভায় ছিলেন, যারা পরবর্তীকালে একে একে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন এবং বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। তারা সকলে ছিলেন দেশমাতার সোনার সন্তান। তবে সকলে পালাতে পারেননি। অনেক বাঙালি অফিসার মন খারাপ করে সেই ৯ মাস এয়ারফোর্সে চাকরি করে গেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন। আমি ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে মহা আতঙ্কে ছিলাম। তাকে কীভাবে নিরাপদ স্থানে পাঠাব, সেই চিন্তায় ছিলাম অস্থির। আমার কবি ও লেখক স্বামী সৈয়দ শামসুল হক- সেই যে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন যে তার চিন্তায় আমি মনে মনে অস্থির হয়ে গেলাম। তাকে আমি জোর করে তার ছেলেবেলার একজন বন্ধুর বাড়ি আশ্রয় নিতে পাঠালাম, কিন্তু তিনি তাকে ধুলো পায়ে বিদায় করে দিলেন। বললেন, তিনি তাকে আশ্রয় দিতে পারবেন না। এর পর তার শরীরজুড়ে বড় বড় ফোড়ার আবির্ভাব হতে লাগল। যার শরীরের চামড়া ছিল মসৃণ, কোনোদিন একটি ঘামাচিও চোখে দেখিনি, সেই শরীরজুড়ে, মুখজুড়ে, ঠোঁটজুড়ে, পেটজুড়ে, পাজুড়ে বের হতে লাগল বড় বড় বিষফোড়া। আমি যেন দিশাহারা হয়ে গেলাম। মেডিকেল স্কোয়াড্রন থেকে পেনিসিলিন ইনজেকশন এনে হাই ডোজে সকাল-বিকেল দিতে লাগলাম। গোপনে। পাকিস্তানি ছেলে নার্স আমি ইচ্ছে করে বাসায় আনলাম না। আমি তাকে বারবার করে আশ্বাস দিতে লাগলাম, তুমি চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে যেভাবে হোক আমি দেশ থেকে বাইরে বের করে দেব। কোনোরকমে সেই সমস্যার হাত থেকে বেঁচেই আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম কোনোরকমে যদি তাকে দেশের বাইরে পাঠাতে পারি, না ইন্ডিয়াতে নয়, তাহলে আমরা সকলেই মরব, চেষ্টা করতে লাগলাম লন্ডন বা এ রকমের কোনো জায়গায় পাঠাতে। লন্ডনে আমার ডাক্তার বন্ধুরা ছিলেন, অনেক বন্ধু, তাদের সাহায্যে তাকে বিদেশে পাঠাতে চেষ্টা করলাম। এবং সফলও হলাম। এদিকে আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে আমাদের মনে সাহস এবং আশা জেগে উঠতে লাগল। আমার তখন যেন রাতের অপেক্ষা করে থাকতাম। কারণ রাত হলেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা তৎপর হয়ে উঠত। জানতাম সেই সব ভাইয়ের বয়স আমাদের নিজেদের ছোট ভাইদের বয়সী, তবু তাদের বন্দুকের গুলির আওয়াজ রাতে না শুনলে আমাদের চোখে ঘুম আসত না। এয়ারফোর্সে তখন আমার ডাক্তারি বলতে কিছু ছিল না। কারণ আমি ছিলাম ফ্যামিলি শাখার ডাক্তার। কিন্তু পাকিস্তানি ফোর্সের সকল ফ্যামিলি, এমনকি ফ্যামিলির একটি পিঁপড়া পর্যন্ত তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছে। ছিল কিছু বাঙালি আফিসারদের পরিবার। আর ক্লাস থ্রি বা ক্লাস ফোর র‌্যাঙ্কের কিছু পরিবার। কিন্তু সকলেই ছিলেন মনে মনে ভীত এবং উদ্বিগ্ন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পালাতে গিয়ে বিফল হয়েছেন, এ রকম খবরও মাঝে মাঝে পেতাম। কিন্তু বাঙালিদের নিজেদের ভেতরেও সন্দেহ-সংশয় কাজ করত। কে কাকে কীভাবে বিপদে ফেলে; কিছু বোঝা মুশকিল ছিল। আমার লেখক মনও সবকিছু একটু একটু করে স্মরণে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কালি কলম দিয়ে কিছু লিখে রাখতে ভয় পেতাম, কারণ তারা বাড়িঘর সার্চ করার সময় খাতা-বইও জব্দ করত। ২৬ মার্চ আমাদের বাসার টেলিভিশন শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল। সেই যে ইয়াহিয়া তার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বললেন- 'দিস ম্যান শ্যাল নেভার গো আনপানিশড্‌।' তার সেই বক্তব্য শুনে সৈয়দ হক মন খারাপ করে সেই যে টেলিভিশন বন্ধ করলেন, তা আর জীবনে খোলা হলো না। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও নয়। কারণ সেই ৯ মাসের আগেই টেলিভিশনটি এক বাঙালি পরিবারের কাছে বিক্রি করে সৈয়দ হকের বিলাত যাত্রার টিকিট জোগাড় করা হয়েছিল। টিকিটের টাকা তুলতে শুধু টেলিভিশন নয়, এনসাইক্লোপিডিয়া, গান শোনার যন্ত্র, কিছু গহনা, কিছু আসবাব বিক্রি করতে হয়েছিল। তাও দেশ স্বাধীনের মাত্র পৌনে তিন মাস আগে। তবু তাকে দেশ থেকে বাইরে বের করতে পেরে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। তারপর শুধু মা আর ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে থাকা। আমার প্রতিটি ভাইবোনের জুতো কেনা ছিল। সেই জুতোর মধ্যে মোজার ভেতরে দুটো করে একশ টাকার নোট ভাঁজ করে রাখা থাকত। নির্দেশ দেওয়া ছিল যেন বিপদ দেখলে যে যেভাবে পারে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাবে। রাতের খাবার ছিল আটার হাতরুটি আর ছোলার ডাল।

সেই হাতরুটি রাতে খেলে কোনোদিন হজম হতো না, পেটের ভেতরে অসম্ভব নড়াচড়া করত। সামান্য শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে যেত। রাতে উঠে উঠে বসে থাকতাম। স্বামীর চিন্তায় চোখে ঘুম আসত না। বিদেশবিভুঁইয়ে সে যে কষ্টে আছে, শীতে কুঁকড়ে আছে কারণ গরম কাপড় কেনার পয়সা নেই এবং সেখানকার কিছু কিছু মানুষের তার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার আমি যেন ভুলতে পারতাম না, আজও পারিনি। সে সময় বিলাতে বসবাসকারী বহু মানুষ ভাবত যে এই যুদ্ধ বছরের পর বছর চলবে, সুতরাং আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও কোনো দোষ নেই! স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সেই ৯ মাসে আমার যে কষ্ট, ভয় আর আতঙ্ক হয়েছিল, তার সবকিছুর নিরসন হয়েছিল যেদিন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সৈয়দ হকের গলায় পুরো বিশ্ববাসী অবরুদ্ধ দেশের মুক্তির সংবাদ পেয়েছিল। লন্ডনে গিয়ে তিনি বিবিসিতে ছুটো কাজ করে হাতখরচ চালাতেন। সেইদিন তার খবর পড়ার কথা ছিল না, ভারতীয় একজনের পড়ার কথা ছিল। কোনো কারণে তিনি সেদিন খবর পড়তে পারেননি, তাই বিকল্প হিসেবে সৈয়দ হককে সেদিনের সকালের খবরটা পড়তে অনুরোধ করা হয়। ভাগ্যিস অনুরোধ করা হয়, তা না হলে বাংলাদেশের মুক্তির সংবাদ একজন বাংলা মায়ের নাড়িছেঁড়া সন্তানের মুখ থেকে বিশ্ববাসী শোনার সৌভাগ্য পেতেন না। সেদিন সাধারণ খবর পড়ার মাঝখানে যুদ্ধ জয়ের খবরটা এসে পৌঁছেছিল, তাই খবর পড়তে পড়তে মাঝখানে থেমে গিয়ে সৈয়দ হককে যুদ্ধ জয়ের খবরটা শ্রোতাদের পড়ে শোনাতে হয়েছিল। এটা ছিল বাঙালিদের জন্য একটি বিরাট প্রাপ্তি। এই কথা সৈয়দ হক পরবর্তী সময়ে আমাকে চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন। সেইসব চিঠি সম্প্রতি তার ৩৫ খণ্ড রচনাবলির ভেতরে তুলে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধের দিনের পুরো খবরই সেইসব চিঠির ভেতরে কিছু কিছু পাওয়া যাবে।

তবে সে সময় এতেই আমার মনে অনেক শান্তি হয়েছিল। যুদ্ধের অনেক কষ্টের ভেতরেও আমি একটু শান্তি পেয়েছিলাম। হয়তো এ কারণেই আমি এত কষ্ট করে তাকে লন্ডনে পাঠিয়েছিলাম। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে!

১৩ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের যখন হত্যা করা শুরু হয়েছিল তখন আমি এয়ারফোর্সের আওতা ছেড়ে পলাতক। আমাদের স্কোয়াড্রন লিডার যিনি একজন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন; এসব নিধন, যুদ্ধ, হত্যা পছন্দ করতেন না, যিনি আমার স্বামীকে জানতেন, তিনি আমাকেও জানতেন, তবু বড় চতুরতার সঙ্গে সবকিছু গোপন রেখেছিলেন, এমনকি আমার গানের যন্ত্রটা কিনে নিয়ে গোপনে আমাকে সাহায্য করেছিলেন, তিনি কথার ইশারায় আমাকে একেবারে লাপাত্তা হয়ে যেতে বললেন।

আমি তাই গেলাম। তা না হলে আমাকে যেভাবে ১৩ তারিখে খোঁজ করা হয়েছিল, আমি যদি গ্রিন রোডের কোয়ার্টারে থাকতাম, তাহলে আমাকে সেখান থেকেই তুলে নেওয়া হতো। আমাকে না পেয়ে সেই বর্বর অফিসার সেই বাড়ির একজন ভাড়াটিয়াকে ভীষণভাবে মুখ খারাপ করে গালি দিয়েছিল। আল্লাহর অসীম রহমতে আমি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। হয়তো এই কথাগুলো বলে যাওয়ার জন্য। আমার যে ভাইকে দু'দু'বার পাকিস্তানি মিলিটারি ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাকেও আমি দু'বার করে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম। বাঘের গুহায় দিবারাত্রি বসবাস করেও আমি একাকী অকুতোভয়ে এই কাজগুলো করেছিলাম শুধু পরিবারকে ভালোবাসতাম বলে, স্বামীকে ভালোবাসতাম বলে এবং ঈশ্বরের অসীম মহিমায় আমি আমার দুটি শিশুসন্তানের মা হিসেবে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকব বলে। আমি জানি, আমার মতো অনেক মা-ই সেদিন তাদের সন্তানদের বাঁচাতে পারেননি; অনেক স্ত্রীই তাদের স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি, ভাইকে বাঁচাতে পারেননি। তাদের জন্য আমার চোখ সারাটি জীবন অশ্রুসজল হয়ে থাকবে। তাদের প্রতি থাকবে আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।