- বাংলাদেশ
- দুর্যোগে পরিবারপ্রতি ক্ষতি সাড়ে ১৮ হাজার টাকা
বিবিএসের জরিপ
দুর্যোগে পরিবারপ্রতি ক্ষতি সাড়ে ১৮ হাজার টাকা

ফাইল ছবি
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উচ্চঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ নবম। গত কয়েক বছর ধরে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত ছয় বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ ৭৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা। পরিবারপ্রতি আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৮ হাজার ৪২৫ টাকা। এ পরিসংখ্যান শুধু দুর্যোগপ্রবণ এলাকার। সারাদেশের হিসাব আমলে নিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।
জরিপের তথ্যমতে, দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে কৃষি। বৃহৎ কৃষি খাত অর্থাৎ শস্য, প্রাণিসম্পদ, হাঁস-মুরগি, মৎস্য ও বনের ক্ষতি সাত লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভূমি ক্ষয়ে ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ খাতের ক্ষতি ৫২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষতি শস্য খাতের ২৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।
‘বাংলাদেশ পরিবেশ পরিসংখ্যান ২০২০’ শিরোনামের জরিপ প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। তবে বিবিএসের ক্ষতির এ খতিয়ানের সঙ্গে দ্বিমতের কথা জানিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে।
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত সমকালকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুই ধরনের ক্ষতি হয়। দৃশ্যমান বা প্রত্যক্ষ এবং অদৃশ্যমান বা পরোক্ষ। একটি ক্ষয় এবং অন্যটি ক্ষতি। বিবিএস কোন পদ্বতিতে আর্থিক ক্ষতির হিসাব করেছে সেটি সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কারণ, সারাবিশ্বেই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পদ্ধতি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি আছে। দৃশ্যমান ক্ষতির খতিয়ান বের করা গেলেও অদৃশ্যমান বা সামাজিক ক্ষতির হিসাব নির্ণয় করা হয় না।
দেশের সব জেলার দুর্যোগপ্রবণ এলাকার খানাভিত্তিক জরিপটি পরিচালনায় ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, জলমগ্নতাসহ ১১টি প্রধান দুর্যোগ বিবেচনায় নিয়েছে বিবিএস। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের তথ্যের ভিত্তিতে জরিপ পরিচালনা করা হয়। বিবিএসের দাবি, এটি সংস্থার অন্যতম বৃহৎ জরিপ। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে মোট ৭৫ লাখ ১৬ হাজার খানার তথ্য নেওয়া হয়েছে। এসব খানা বা পরিবারে জনসংখ্যা তিন কোটি ৪১ লাখ ১২ হাজার। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বড় ধরনের কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার।
জরিপের তথ্য সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যেখানে যে সমস্যা আছে তা সমাধান করা হবে।’ আর পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, তথ্য-উপাত্তই পরিকল্পনার ভিত্তি।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান, বিবিএসের মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম ও প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন।
দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বেকারত্ব দ্বিগুণ
জরিপের ফল থেকে দেখা যায়, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বেকারত্ব বাড়ছে প্রায় দ্বিগুণ হারে। এসব এলাকার মানুষ গত ছয় বছরে গড়ে ২১ দশমিক ০৩ দিন বেকার ছিল। ছয় বছর আগের পরিসংখ্যানে এ হার ১২ দশমিক ১৩ দিন। আগের জরিপে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের তথ্য ছিল। দুর্যোগকালে বেকারত্বের প্রধান কারণ বন্যা।
বন্যায় তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। ফাইল ছবি
বেকারত্বের মোট দিনের ৪২ দশমিক ৬৮ দিন বেকার থাকতে হয়েছে বন্যার কারণে। দুর্যোগের ধরন হিসেবে বন্যায় ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। ছয় বছরে এ বন্যায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ এক হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট আর্থিক ক্ষতির ৫৬ দশমিক ৪১ শতাংশই হয় বন্যায়। দুর্যোগ হিসেবেও শীর্ষে রয়েছে বন্যা। ৫৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ পরিবার বন্যায় আক্রান্ত হয়। এর পরে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয় ৩৪ শতাংশ। বজ্রপাত এবং বজ্রঝড়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
বেড়েছে ভিক্ষাবৃত্তি
দুর্যোগপ্রবণ পরিবারগুলো কীভাবে চলছে তারও চিত্র তুলে আনা হয়েছে জরিপে। এতে দেখা যায়, দুর্যোগের কারণে ভিক্ষাবৃত্তি বেড়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি এবং গৃহপরিচারিকার কাজ করে জীবন নির্বাহ করছে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ মানুষ। ছয় বছর আগে এ হার ছিল ২ শতাংশ।
এ ছাড়া জরিপে দেখা গেছে, আয়ের উৎস হিসেবে কৃষির ওপর নির্ভরতা কমছে। নতুন জরিপে আয়ের উৎস হিসেবে কৃষিনির্ভরতা এখন ৩৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবারের। ছয় বছর আগে এ হার ছিল ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে দিনমজুরি। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশ মানুষ কৃষি এবং অকৃষি দিনমজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তদের আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে আগের ছয় বছরের চেয়ে গেল ছয় বছরে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। জরিপে দেখা যায়, ৭৪ দশমিক ০২ শতাংশ পরিবার দুর্যোগকালে সরকারি আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। আগের ছয় বছরে এ হার ছিল ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি ২৬ শতাংশ কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা পায়নি।
শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলো। জরিপে দেখা যায়, কোনো ধরনের শিক্ষাগ্রহণ করেনি দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় এ হার ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আগের ছয় বছরে ৩৮ শতাংশ ছিল এ হার। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাসের সংখ্যা ৩৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। আগের একই সময়ে এ হার ছিল ৩৩ শতাংশ।
মন্তব্য করুন