- বাংলাদেশ
- বৈষম্য বিরোধী আইনের অন্তর্ভুক্তিমূলক সংশোধন ও গঠনমূলক প্রয়োগ প্রয়োজন
বৈষম্য বিরোধী আইনের অন্তর্ভুক্তিমূলক সংশোধন ও গঠনমূলক প্রয়োগ প্রয়োজন
নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এর মিডিয়া ব্রিফিং

নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিং
সংবিধানের মৌলিক ধারাগুলোর উপর ভিত্তি করেই জাতীয় সংসদে বৈষম্যবিরোধী বিল ২০২২ উত্থাপন করা হয়েছে। তবে, এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দৃশ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন। একইসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আইনের অন্তর্ভুক্তিমূলক সংশোধনেরও দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। বৈষম্যবিরোধী যে বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে তা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তারা এ দাবি জানান। রোববার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারের ইন মিলনায়তনে এই মিডিয়া ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়।
নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুদিন ধরেই এমন একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত নাগরিক সম্মেলনের ঘোষণাপত্রেও এই আইনের দাবি করা হয়েছিল।
মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এর আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বহুদিন ধরেই নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এই আইন উত্থাপনে ও খসড়া প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করে আসছে। ২০১৭ সালে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রেও এই আইন উত্থাপনের দাবি করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে, সংবিধানের মৌলিক ধারাগুলোর উপর ভিত্তি করেই এই আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে। তবে, এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্যে দৃশ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন।
সভা প্রধান হিসেবে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ২০০৭ সালে প্রথম এর কাজ শুরু হয় এবং লক্ষ্য করা হয়, বৈষম্যকে সুনিদির্ষ্টভাবে লক্ষ্য করে কোনো আইন নেই। পরবর্তীতে জনমত জরিপের মাধ্যমে ২০১৩ সালে আইন কমিশনে খসড়া জমা দেওয়া হয়। এখন এই আইনটি জনগণের প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে সেজন্য সঠিক মনিটরিং কমিটি প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। জনবান্ধব, বিশেষত এমন নারীবান্ধব আইন উত্থাপনের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, এই আইন উত্থাপন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের রয়েছে।
নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন, বলেন, ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে কি ধরনের বৈষম্য চর্চা হয়, সেটা বোঝা খুব কঠিন। উত্থাপিত আইনে সুস্পষ্টভাবে কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয় নেই। এক্ষেত্রে আইনে সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান থাকা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে মনিটরিং কমিটির মেয়াদ ২ বছরের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী (যেমন- হিজড়া, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু) তাদের বিরুদ্ধে হওয়া বৈষম্যের ব্যাপারে জানিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে একটি আইনের মাধ্যমে সব ধরনের বৈষম্যকে কেন্দ্রীভূত করার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে, আইনে বৈষম্যের সংজ্ঞায় এখনো কিছু সমস্যা আছে। যেমন – যৌনকর্মীদের পেশা বৈধ কিনা, এ ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, বৈষম্যের প্রতিকার কীভাবে হবে সেটা এই আইনে স্পষ্ট নয়। এছাড়া, রাষ্ট্রের অনেক আইনেই বৈষম্যমূলক ধারা আছে। যেমন – সাক্ষ্য আইনের মাধ্যমে ধর্ষিতার চরিত্র হনন, একজন নারীর কাজী না হতে পারা কিংবা প্রতিবন্ধীদের বিসিএস বা জুডিশিয়াল সার্ভিসে সক্রিয়ভাবে যোগদানের সীমাবদ্ধতা। তাছাড়া, মনিটরিং কমিটির ক্ষমতা, কার্যব্যপ্তি এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের সিনিয়র ফেলো ড. ফস্টিনা পেরেইরা বলেন, প্রতিকারের জায়গাটা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। যেমন – একজন ব্যক্তি একের বেশি ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি কী ধরনের প্রতিকার পাবেন, সেটা স্পষ্ট নয়। এছাড়া, উত্থাপিত আইনে অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে সবশেষে প্রতিকার পেতে এক ধরনের প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্যণীয়। একজন ক্ষতিগ্রস্ত নিজ থেকে অভিযোগ দায়ের করার আগেই ক্ষতিগ্রস্তের জন্যে রাষ্ট্রকে নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
রাজনৈতিক শূন্যতার প্রেক্ষিতে বর্তমানে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার ব্যপ্তি ঘটানোর জন্যেই সব ধরনের আইন প্রণিত হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট-এর আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি উত্থাপিত আইনে প্রতিকারের জন্যে যে মনিটরিং কমিটিগুলোর কথা উল্লেখ আছে, তাদের কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মনে করেন, অনেকক্ষেত্রেই এই ধরনের আইনে মনিটরিং কমিটি গঠিত হলেও, তাদের কোনো ধরনের সভা অনুষ্ঠিত হয় না। ফলে, আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দেখা যায় না।
প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈষম্যের কাঠামোগত সংজ্ঞায়নে মানসিক প্রতিবন্ধি, বর্ণবৈষম্য ও এসিডদগ্ধদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ। এছাড়া, এই আইনে ভূমির আইনগত মালিকদের কথা বলা হলেও, প্রথাগতভাবে ভূমির মালিকদের তথা আদিবাসীদের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আইন বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতি আলোকপাত করে তিনি উল্লেখ করেন, একটি বৈষম্যবিরোধী কমিশন গঠন করার মাধ্যমে উত্থাপিত আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটা দেখা জরুরি।
মন্তব্য করুন