- বাংলাদেশ
- প্রণোদনার চালে নয়ছয়
প্রণোদনার চালে নয়ছয়

ফাইল ছবি
বরিশালের হিজলার হরিনাথপুরের মহিষখোলা গ্রাম। গ্রামের কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে মেঘনা নদী। লুৎফর রহমানের সংসার চলে এই নদীতে মাছ ধরে। কিন্তু দুই মাসের জন্য মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আয়ের পথ বন্ধ এখন তার। আগের বছরগুলোতে সরকারের খাদ্য সহায়তা (চাল) পেলেও এ বছর খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ হয়নি তার। তার মতো আরও অনেক প্রকৃত জেলেই সহায়তা থেকে বঞ্চিত বলে অভিযোগ করেছেন মহিষখোলা গ্রামের এই অধিবাসী।
জাটকা সংরক্ষণের লক্ষ্যে ইলিশের পাঁচ অভয়াশ্রম বরিশাল, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, শরীয়তপুর ও পটুয়াখালীতে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দুই মাসের জন্য সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একদিকে আয়ের প্রধানতম পথ বন্ধ, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। ফলে হিমশিম খেতে হচ্ছে জেলে পরিবারগুলোকে। আবার নানা অনিয়মে অনেক জেলেই পাচ্ছেন না সরকারি খাদ্য সহায়তা। কেউ পেলেও পরিমাণে তা অপর্যাপ্ত।
এ পরিস্থিতিতে জেলেরা বাধ্য হয়ে মাছ ধরতে নদীতে নামছেন। আর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় প্রশাসন তাদের আটক করে জেল-জরিমানা দিচ্ছে। এমনকি প্রাণও যাচ্ছে জেলের। গত রোববার ভোরে লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর হাটে নৌ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন এক জেলে। এ অবস্থায় রমজান এবং আসন্ন ঈদ উদযাপন নিয়ে জেলে পরিবারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার এই দুই মাসে প্রতিটি জেলে পরিবারের জন্য সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ৮০ কেজি চাল। বরিশালের অধিকাংশ ইউনিয়নে প্রকৃত জেলেরা চাল পাচ্ছেন না। যারা পাচ্ছেন তাদের ৫ থেকে ১০ কেজি করে চাল কম দেওয়া হচ্ছে। আবার চাল দেওয়ার শর্তে চৌকিদারি ট্যাক্সের নামে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকাও নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ জেলেরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভও করেছেন।
জাতীয় ক্ষুদ্র জেলে সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আকন হোসেন সিকদার বলেন, জেলেদের প্রণোদনার চাল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ভোট রাজনীতির পুঁজি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা গোপনে তাদের নিজস্ব লোকজনের বাড়িতে স্লিপ পৌঁছে দিচ্ছেন। স্লিপ অনুযায়ী চাল দিচ্ছেন তারা। চাল বিতরণে টাস্কফোর্স থাকলেও নেই কোনো কার্যকারিতা।
হিজলা উপজেলার বড়জলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনায়েত করীম উপজেলা জাতীয় ক্ষুদ্র জেলে সমিতির সভাপতিও। তার ইউনিয়নে জেলেদের কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করে তিনি বলেন, গ্রামের লোকজন ট্যাক্স দিতে অভ্যস্ত নন। চাল বরাদ্দ বণ্টনের সুযোগে তাই জেলেদের কাছ থেকে ২০০ টাকা করে চৌকিদারি ট্যাক্স নেওয়া হচ্ছে। চাল কম দেওয়া হবে না এমন শর্তে জেলেদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১০০ টাকা নিচ্ছেন তিনি। এ চেয়ারম্যান জানান, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত চাল পৌঁছাতে সরকারি খাত থেকে প্রতি টনে ৩০০ টাকা খরচ দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের খরচ হয় আরও অনেক বেশি। তাই সব ইউনিয়নেই খরচ উঠাতে জেলেদের কম চাল দেওয়া এখন অলিখিত নিয়ম হয়ে উঠেছে।
বানারীপাড়া উপজেলার সৈয়দকাঠি ইউনিয়নে চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে গত রোববার দুপুরে বরিশাল নগরীতে মানববন্ধন ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন জেলেরা। তাদের অভিযোগ, প্রত্যেক জেলের জন্য ৮০ কেজি চাল বরাদ্দ থাকলেও ৩৮-৪০ কেজি করে দেওয়া হচ্ছে। এ ইউনিয়নে চালের বিপরীতে ২০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়ন শাখা জাতীয় ক্ষুদ্র জেলে সমিতির নেতারা অভিযোগ করেন, এ ইউনিয়নে জেলে নন, এমন ৪২ ব্যক্তির নামে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. জুয়েল জানান, জেলেদের তালিকা তিনি করেননি। তার এলাকায় জেলে নন এমন ১৫-২০ জন চাল পেয়েছেন। বিষয়টি মৎস্য কর্মকর্তাও জানেন।
চরমোনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো জিয়াউল করিম বলেন, জেলেদের তালিকা করেছেন মেম্বাররা। জেলেদের দুই সমিতিতে কার্ডধারী জেলে ২২০০। অথচ বরাদ্দ এসেছে ৬৬৩ জনের নামে।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের ছয় জেলায় তালিকাভুক্ত তিন লাখ ১১ হাজার ৫১ জেলের বিপরীতে বরাদ্দ এসেছে দুই লাখ ৪৯ হাজার ১০২ জনের জন্য। এ হিসাবে প্রায় ৬২ হাজার জেলে খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত।
বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনিছুর রহমান বলেন, যেসব জেলে এ বছর বরাদ্দ পাননি আগামী বছর তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
ভোলায় ৯২ হাজার ৬৬১ জন জেলেকে মাসে ৪০ কেজি করে খাদ্য সহায়তা দিলেও বাকি ৬৫ হাজার জেলে সহায়তা পাননি।
চাঁদপুরের পুরাণবাজার ও হাইমচরের কয়েকজন জেলে বলেন, প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা মিলছে না। সহায়তা আরও বাড়ানো দরকার। লক্ষ্মীপুরে অধিকাংশ জেলে সরকারের সহায়তা পাননি। জেলা মৎস্য অফিস জানায়, ৫২ হাজার জেলের মধ্যে নিবন্ধিত ৩৯ হাজার।
কমলনগরের চরকালকিনি এলাকার জেলে চুন্নু, কবির হোসেন, বাবুল মিয়া ও আলামিন বলেন, একে তো উপার্জন বন্ধ, তার ওপর সরকারি প্রণোদনা পান না তারা। এ ছাড়া আড়তদারদের দাদনের চাপ ও বিভিন্ন এনজিওর কিস্তির টাকা পরিশোধের চাপ তো আছেই। চাল নয়, ব্যাংক ঋণসহ মোবাইলের মাধ্যমে নগদ অর্থ চান জেলেরা।
রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ও চর জালিয়া গ্রামের একাধিক জেলে জানান, তারা কোনো সরকারি সহায়তা পাননি।
জেলার কমলনগর উপজেলার চর লরেঞ্চ ইউনিয়নে কার্ডধারী জেলে রয়েছেন ৪০৫ জন। ওই ইউনিয়নে ৩২৫ জনের জন্য ৮০ কেজি করে বরাদ্দ আসে ২৬ টন চাল। ২ এপ্রিল স্থানীয় ইউপি কার্যালয়ে চাল বিতরণ হয়। এ সময় ২০-২৫ জন জেলেকে ৮০ কেজির পরিবর্তে ৬০ কেজি চাল দেওয়া হয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন মাস্টার জানান, কার্ডধারীর চেয়ে প্রকৃত জেলের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই সবাইকে চাল দেওয়ার জন্য ৮০ কেজির পরিবর্তে ৬০ কেজি করে দেওয়া হয়েছে।
ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় মুন্সীগঞ্জের সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে চাল বিতরণ হলেও এখনও মার্চ মাসের চাল বিতরণ হয়নি।
মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনার ওপরে জোর দিয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, মৎস্যজীবীদের সন্তানরা যাতে পড়ালেখা করে অন্য পেশায় যেতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে হবে। জেলেদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে সামগ্রিকভাবে ভাবতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশের ইকো ফিশ প্রকল্পের দলনেতা আবদুল ওহাব বলেন, সারা বছরই নানা কারণে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা যোগ করলে তা ১৪৮ দিন হয়। এ সময় জেলেদের অনেকেই মাছ ধরতে পারে না। জেলেদের সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা আরও বাড়ানোর পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞাকালীন প্রতি মাসে প্রতিটি জেলে পরিবারকে দুই হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বরিশাল বুরো এবং লক্ষ্মীপুর, ভোলা, মুন্সীগঞ্জ ও চাঁদপুর প্রতিনিধি)
মন্তব্য করুন