শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। এই সংকট দেশের প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। শিক্ষা খাতে সরকারের নেওয়া নানা সিদ্ধান্ত সরকারই বাস্তবায়ন করে না। ক্ষেত্রবিশেষে আমলাতন্ত্রও একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেছেন। বুধবার সকাল ১১টায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম জুমে অনুষ্ঠিত 'দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতের রাজনৈতিক অর্থনীতি' শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

অনুষ্ঠানে 'দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি: দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই' নামের একটি বইয়েরও মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইটি লিখেছেন জন রিচার্ডস, শহীদুল ইসলাম ও ড. মনজুর আহমেদ।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সিপিডির ট্রাস্টি শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ সাবেক অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ, গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক কে এম এনামুল হক, ডেইলি স্টারের সহকারী সম্পাদক ইরেশ ওমর জামাল এবং ওয়ার্ল্ড ভিশনের প্রতিনিধি টনি মাইকেল গোমেজ। বইয়ের ওপর লেখক তিনজন আলোচনা করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থী তৈরি করা হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় শাস্ত্রীয়, মানবিক গুণবালি সম্পন্ন জ্ঞানমূলক ধারা বাদ পড়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিম্নমানের শিক্ষা নিয়ে মূলধারায় প্রবেশ করছে, যা অশনিসংকেত।

তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ধারা একই সঙ্গে চলায় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা আমাদের দেশে প্যারালাল শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে মানের দিক থেকে তা যে আহামরি কিছু, এমন নয়। শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মাদ্রাসা শিক্ষায় ধাবিত হচ্ছে, তবে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা সেখানে মেলে না। মাধ্যমিক স্তরে স্কুল ম্যানেজিং কমিটিগুলো রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত। এতে শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, উচ্চ শিক্ষার জন্য আমরা স্ট্র্র্যাটেজিক প্ল্যান তৈরি করেছিলাম। সরকার তা গ্রহণ করলেও বাস্তবায়ন করেনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে বহু ভালো সিদ্ধান্ত হয়, তবে তা বাস্তবায়িত সব সময় হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে আমলাতন্ত্রও একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, মানসম্মত গ্র্যাজুয়েটরাই মানসম্মত শিক্ষক তৈরি করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে ধরে রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বাজারমুখী শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার মূল লক্ষ্যকে ব্যাহত করছে। মানবিক, কলা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা- শিক্ষা থেকে দিন দিন উঠে যাচ্ছে।

ড. বিনায়ক সেন বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পারিবারিক দারিদ্র্য একটি বড় বাধা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে ঝরে পড়ার সর্বোচ্চ হার। তিনি বলেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম কিন্তু ও লেভেল আর এ লেভেলে গিয়ে স্কুলে আর পড়াশোনা থাকছে না। তা কোচিং সেন্টারমুখী হয়ে পড়ছে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মেগা প্রকল্পই দেশের জন্য যথেষ্ট নয় বলে উল্লেখ করেন ড. মনজুর আহমেদ। তিনি বলেন, শিক্ষাকে অদূরদর্শী রাজনীতি থেকে রক্ষা করতে হবে। একটি বিকেন্দ্রীভূত শাসন কাঠামোর মধ্যে সব স্কুলশিক্ষা একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসা উচিত। তিনি 'জেলা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ' গঠনের প্রস্তাব করেন।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শিক্ষানীতি করার পরও তা বাস্তবায়িত হলো না কেন। কেন রাতের আঁধারে পাঠ্যবই বদলে ফেলা হলো একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর দাবির মুখে।

ইরেশ ওমর জামাল বলেন, ভালো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য দরকার ভালো শিক্ষক। শিক্ষকদের মধ্যে রোল মডেল হতে পারেন- এমন শিক্ষক কই? বিজ্ঞানের কথা বললে শিক্ষককে গ্রেপ্তার হতে হয়। বাকস্বাধীনতা না থাকলে শিক্ষক ফ্রিভাবে পড়াবেন কেমন করে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতিকীরণ এবং শিক্ষকদের বাকস্বাধীনতার অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।