- বাংলাদেশ
- হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলা: দেরিতে হলেও রায়টি স্বস্তিদায়ক
হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলা: দেরিতে হলেও রায়টি স্বস্তিদায়ক
তার পরিবারের সদস্যদের মতো অনেকেই যখন হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে, হয়তো হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলাটি আর রায়ের মুখ দেখবে না তখনই ওই মামলার রায় ঘোষিত হলো। বৃহস্পতিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যেমনটি বলা হয়েছে, বুধবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে চার অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মামলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ হওয়ার কারণটা এই যে, হুমায়ুন আজাদ জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছিলেন ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, আর রায় হলো তার ১৮ বছর পর। তা ছাড়া, এ মামলায় চার্জশিট দিতে পুলিশের আট বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। অন্যদিকে, দণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামির মধ্যে দু'জনকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি। উল্লেখ্য, অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করার পরদিন তার ছোট ভাই রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। দেশে-বিদেশে কয়েক মাসের উন্নত চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পর হুমায়ুন আজাদ ওই বছরের আগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানি যান। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই নিজ ফ্ল্যাটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। জার্মানিতে মৃতদেহের যে ময়নাতদন্ত করা হয় তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মারাত্মক জখম হওয়ায় এবং হাইপারটেনশনে হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের অনুমতি নিয়ে অধিকতর তদন্তের পর হত্যাচেষ্টা মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করা হয়।
এটাও মনে রাখতে হবে যে, হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার মাত্র কয়েক মাস পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়; ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলা চলে। শুধু তা নয়, তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার একদিকে এসব জঙ্গি তৎপরতাকে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য জোগায়, আরেকদিকে হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলাসহ জঙ্গি-সংযোগ আছে এমন সব মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্ট চালায়। আরও দুঃখজনক হলো, যে আওয়ামী লীগ সেই সময়ে জঙ্গি তৎপরতার সবচেয়ে বড় ভিকটিম ছিল, তারাই ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর, সংগঠিত জঙ্গি তৎপরতা বন্ধে সচেষ্ট হলেও, বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তমনা মানুষের ওপর জঙ্গি হামলার বিচারের বিষয়ে রহস্যজনকভাবে এক ধরনের ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করা শুরু করে। সবার নিশ্চয় এ সরকারের আমলে জঙ্গিদের হাতে বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়, যুক্তিবাদী লেখক অনন্ত বিজয় দাশসহ একগুচ্ছ প্রগতিমনা তরুণ লেখক-প্রকাশকের খুন হওয়ার কথা মনে আছে। দু'একটি ছাড়া ওই মামলাগুলোর কোনোটারই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আধা যুগের বেশি পার হলেও খুব বেশি অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। এ পরিস্থিতি দেখেও অনেকে মনে করেছিলেন, হুমায়ুন আজাদের মামলাটিও হয়তো ঝুলে থাকবে। এমনটি ভাবার জন্য অবশ্য, কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ বিগত কয়েক দশক ধরে দেশে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মাঝে ধর্মীয় উগ্রবাদী চিন্তার এতটা প্রসার ঘটেছে যে, যে কোনো যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে নিজের চিন্তাকে মুক্তভাবে প্রকাশ করাও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আর সরকারও এ বিপদ কাটাতে খুব একটা তৎপর এমনটা বলা যাবে না।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় হয়েছে এবং অপরাধীরা সবাই সর্বোচ্চ সাজা পেয়েছে- এটা স্বস্তিদায়ক। এতে একদিকে যেমন দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত মিলছে, আরেকদিকে তেমনি জঙ্গি হামলায় নিহত অন্যদের মামলাগুলোও গতি পাবে- এ ভরসা করা যায়। হুমায়ুন আজাদের পরিবারের মতো আমরাও আশা করি, হুমায়ুন আজাদের খুনিদের সাজা উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে এবং দ্রুত দণ্ড কার্যকর হবে। তবে এ রায় কার্যকরের পাশাপাশি সরকার যদি হুমায়ুন আজাদের মতো মুক্তমনের সৃজনশীল মানুষদের জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ব্রতী হয় সেটাই হবে হুমায়ুন আজাদের প্রতি সম্মান জানানোর সবচেয়ে ভালো উপায়।
মন্তব্য করুন