- বাংলাদেশ
- ব্যক্তি পুলিশের অপরাধ প্রশ্নের মুখে বাহিনী
ব্যক্তি পুলিশের অপরাধ প্রশ্নের মুখে বাহিনী

নববর্ষের দিনে কুমিল্লা নগরীর এক পার্কে বসে চুটিয়ে গল্প করছিল প্রেমিক যুগল। দু'জনার একান্ত আলাপচারিতা দূর থেকে মোবাইল ফোনে ভিডিও করতে থাকেন ডিবি পুলিশের দুই কনস্টেবল নজরুল ইসলাম ও রোমান হাবিব। পরে প্রেমিক যুগলের পরিচয় জানতে চেয়ে করেন একের পর এক আপত্তিকর প্রশ্ন। পুলিশের দুই সদস্য ভিডিওটি ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই অকাজের দায়ে কুমিল্লা জেলা ডিবি পুলিশের ওই দুই সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক প্রতারণা, ছিনতাই, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, ধর্ষণচেষ্টা, নারীর প্রতি অসম্মানজনক আচরণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। ব্যক্তি পুলিশের অকাজে দাগ পড়ছে বাহিনীতে। আইনের মানুষের এমন নৈতিক স্খলনে বিব্রত বাহিনীর নীতিনির্ধারকরাও।
গত বৃহস্পতিবার ১১ বছরের এক শিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ফেনীতে গ্রেপ্তার হন কনস্টেবল মোহাম্মদ ইউনুস। সম্প্রতি পুলিশ কনস্টেবল আবদুল হাকিম নিজের নাম ফাটাতে জোচ্চুরির আশ্রয় নেন। সংগ্রাম করে লেখাপড়া চালিয়ে কনস্টেবল থেকে বিএসএস পরীক্ষার মাধ্যমে এএসপি হওয়ার গল্পের কুশীলব হয়ে যান নিজেই। দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে চমকপ্রদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে বেরিয়ে আসে, তার এএসপি হওয়ার ঘটনা পুরোটাই নাটক। এর পর থেকে আবদুল হাকিম নিখোঁজ। তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশকে সবচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে টিপকাণ্ড। ২ এপ্রিল রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্তের শিকার হন তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক ড. লতা সমদ্দার। তার অভিযোগ ছিল, "হেঁটে কলেজে যাওয়ার সময় পাশ থেকে দাড়িওয়ালা মধ্যবয়সী একজন 'টিপ পরছস কেন' বলে গালি দেন তাকে। ওই মধ্যবয়সী ব্যক্তির শরীরে ছিল পুলিশের পোশাক। ঘটনার প্রতিবাদ জানালে এক পর্যায়ে তার পায়ের ওপর দিয়ে বাইক তুলে দেন ওই ব্যক্তি।" পরে এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি অভিযোগ করেন তিনি। ঘটনার দু'দিন পর ৪ এপ্রিল তেজগাঁও থানা পুলিশ অভিযুক্ত কনস্টেবল নাজমুল তারেককে শনাক্ত করে। এ ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির কাছেও মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন নাজমুল।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর গড়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এ রকম বিভিন্ন অভিযোগ আসে। গড়ে প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্যের নানা মাত্রিক অনিয়মের সাজা হয়। এদের একটি বড় অংশ পায় লঘু দণ্ড, কেউ কেউ পান গুরু দণ্ড।
কর্মকর্তারা এও বলছেন, শুরুতে পুলিশের অনেক ঘটনা বাহিনীর ভেতর থেকেই কেউ কেউ চেপে রাখার চেষ্টা করেন। এ কারণে ভুক্তভোগীরা বিচার পান না। আর বড় অপরাধ করেও ছোট সাজায় পার পান কেউ কেউ।
পুলিশ প্রবিধান পিআরবি-১৮৬১ অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান রয়েছে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিত এবং বিভাগীয় মামলা হয়। গুরু দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রয়েছে।
আইনের মানুষের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ঠেকাতে হলে নৈতিকতার বিষয়গুলো বাহিনীর ভেতরে আরও বিশদভাবে চর্চা করা উচিত বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। কনস্টেবল থেকে এএসপি পদে প্রশিক্ষণকালে যেভাবে নীতিনৈতিকতার মানদণ্ডের কথা পাঠ্যক্রমে শেখানো হয়, তা যথেষ্ট কিনা- সেই প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হয়েও যারা বেআইনি কাজে জড়াচ্ছেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কথাও বলছেন সংশ্নিষ্টরা। 'জিরো টলারেন্স' নীতি নিয়ে বাহিনীর ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালানোর পরামর্শও দিয়েছেন কেউ কেউ।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইলের পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের প্রধান ডিআইজি মো. মইনুল ইসলাম বলেন, 'নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা, মানবাধিকার, ধর্মীয় সম্প্রীতি, নৈতিকতার বিষয়গুলো পুলিশের প্রতিটি কোর্সে রয়েছে। একাডেমিক ক্লাস ছাড়াও গ্রুপ স্টাডি, ওয়ার্কশপ ও এর বাস্তবিক প্রয়োগ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দেওয়া হয় সেখানে। দীর্ঘ সময় চাকরি করার পর কীভাবে মেজাজ ধরে রাখতে হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হচ্ছে। নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণের ব্যাপারে উচ্চ আদালত ছাড়াও জাতিসংঘের একটি নীতিমালা রয়েছে। আমরা এসব অনুসরণ করে থাকি।'
মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ অপরাধে জড়ালে তা সমাজে ভুল বার্তা যায়। নিয়োগের সময় শিক্ষা, মানসিক গড়ন ও তাদের পারিবারিক বিষয়গুলো বিশ্নেষণ করা জরুরি। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হলে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। কেউ কেউ মনে করেন, পুলিশ অপরাধ করলেও সাজা হবে না- এ ধারণা ভাঙতে হবে।'
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, 'পুলিশের প্রত্যেক সদস্যকে নারী ও শিশুর প্রতি দরদি হতে হবে। শুধু প্রশিক্ষণ করিয়ে তো মানুষের স্বভাব বদলানো যাবে না। ভেতর থেকেও ভালো মানুষ হওয়ার তাড়না থাকতে হবে। যারা অসংবেদনশীল আচরণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে বাহিনীকে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে অন্যদের মধ্যে কঠোর বার্তা পৌঁছে।'
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, 'ব্যক্তির দায় পুলিশ বাহিনী নেয় না। মাদক সেবনের দায়ে তো অনেক পুলিশ সদস্যের চাকরি গেছে। অনেকের শাস্তি প্রক্রিয়াধীন। অন্য অপরাধে যারা জড়িয়েছে, তাদের পক্ষে বাহিনী লড়ছে- এমন নজির নেই।'
ফেসবুক বাতিক: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে গেলে কিছু নিয়ম মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে পুলিশের। বিভিন্ন সময় পুলিশ বাহিনী থেকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনাও জারি করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাষ্ট্র, সরকার বা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন ছবি, ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, ট্যাগিং করা যাবে না। জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিপন্থি কোনো কমেন্ট বা কনটেন্ট আপলোড করা যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর পরও পুলিশের কোনো কোনো সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কিত পোস্ট ও কমেন্ট করেই যাচ্ছেন। টিপকাণ্ডের পর ওই কনস্টেবলকে সমর্থন জানিয়ে ফেসবুকের দেয়ালে লেখেন সিলেটের এক পুলিশ পরিদর্শক। এ ঘটনায় প্রথমে তাকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে পরে অন্য ইউনিটে বদলি করা হয়। টিপ ইস্যুতে ঢাকার আরেক পুলিশ কর্মকর্তা ফেসবুকে একটি ছবি প্রকাশ করেন, যেখানে কুকুরের কপালে টিপের ছবি ছিল। কিছু সময় পর ছবিটি মুছে ফেলে ফেসবুকে ক্ষমা চান তিনি।
এর আগে সোনারগাঁয়ে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক নারীসহ অবরুদ্ধ হওয়ার পর ফেসবুক লাইভ করে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। তার বক্তব্য ভাইরাল হলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া কুমিল্লার নির্বাচন নিয়ে বিতর্কিত পোস্ট দেন এএসপি জুয়েল রানা। চৌদ্দগ্রামে ইউপি নির্বাচনে ভোট ইস্যুতে একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়। সেখানে জুয়েল রানা বলেন, 'আপনি নৌকার প্রার্থী হয়েছেন বলেই চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন- বিষয়টি এমন না। আমি যেখানে ডিউটি করেছি, নৌকা পেয়েছে ২৫১ ভোট। নৌকার প্রার্থী বলতে পারেননি, ভোট সুষ্ঠু হয়নি। শুধু নৌকা নিয়ে আসলেই, টাকাপয়সা থাকলেই, বড় বড় নেতার আত্মীয়স্বজন হলে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যাবে না। ভোটকেন্দ্র অনেকে দখল করতে আসেন; চোর ধর্মের কথা শোনে না। কুত্তার লেজ সোজা হয় না। আমাদের অস্ত্র রেডি আছে, প্রশিক্ষণ আছে; সরকার গুলি দিছে। অর্ডার আছে। আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। আমরা কি বসে থেকে ফিডার খাব? গুলি করব। হাত-পা যদি দু-চারজনের উড়ে যায়, আমাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।' এমন পোস্টের পর জুয়েলকেও বদলি করা হয়।
নৈতিক স্খলন: সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের বিষয়টি তার স্ত্রী জেনে গেলে তিনি তুলকালাম ঘটনা ঘটান। এ ঘটনায় শুরু হয়েছে তদন্ত। কর্মস্থল থেকে তাকে বদলি করা হয়। গত বছর এক ব্যবসায়ীর স্বর্ণ আত্মসাৎ করে গ্রেপ্তার হন ফেনী জেলা ডিবি পুলিশের ওসি সাইফুল ইসলামসহ ছয় সদস্য। এ ছাড়া জাতিসংঘ শান্তি মিশনে থাকাকালে একজন নারী পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে। দেশে ফেরার পর তাদের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
মন্তব্য করুন